ঢাকা     বৃহস্পতিবার   ১৮ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৫ ১৪৩১

শৈশবে মানসিক স্বাস্থ্য এবং এর অন্তরায় : ২য় পর্ব

মোঃ আমিরুল ইসলাম প্রামাণিক || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১২:৫৮, ৩ অক্টোবর ২০১৮   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
শৈশবে মানসিক স্বাস্থ্য এবং এর অন্তরায় : ২য় পর্ব

মোঃ আমিরুল ইসলাম প্রামাণিক : শৈশবে মনের স্বাস্থ্য ও এর অন্তরায়সমূহ নিয়ে লেখার প্রথম পর্বে শিশুকালে, একটু বাড়ন্ত বয়সে এবং বয়ঃসন্ধিকালের কিছু সমস্যা তুলে ধরা হয়েছে। যা কেবলই মানসিক ও স্নায়বিক বিষয়াদির সাথে সম্পর্কিত। শৈশবের অবশিষ্ট সমস্যাগুলো এবার নিচে তুলে ধরছি-

শিশুকে বাবা-মা অথবা তার চেনা-জানা পরিবেশ থেকে হঠাৎ করে পৃথক করে দেয়া হলে এক ধরনের মানসিক লক্ষণ প্রকাশ পায়। শিশু তখন অচেনা পরিবেশ অথবা বাবা-মা থেকে আলাদা হওয়ায় সব সময় এক প্রকার মানসিক আতঙ্কে ভোগে। শিশুর এই অবস্থাকে সেপারেশন অ্যাঙ্কজাইটি বলে। নিকট কোন ব্যক্তির থেকে পৃথক বা বিচ্ছিন্ন হয়ে থাকার থেকে এই জাতীয় মানসিক অবস্থা জন্ম নেয়। এক্ষেত্রে শিশু প্রকাশ্য কোন স্থানে যেতে ভয় পায়, সর্বদাই কারোর অনুপস্থিতি অথবা তার চিন্তার অনুপস্থিতি তাকে কষ্ট দেয়। এটি এক প্রকার মানসিক ভারসাম্যহীনতা। এই জাতীয় মানসিক ভারসাম্যহীনতা কোন মানসিক রোগের পরবর্তী পর্যায়ে দেখা দেয় না। আর এই অবস্থাকে ডিপাশ্রোনালাইজেশন ডিসঅর্ডার বলে। অনেক শিশুর মানসিক বিকৃতি মন ভেঙ্গে যায়, যাতে মেজাজ বিগড়িয়ে যায় ও রোগী অন্যের সঙ্গে অসঙ্গত আচরণ করে। যাকে সিজোফ্রেনিয়া  বলে।

অনেক শিশু হঠাৎ করে উত্তেজিত হয়ে পড়ে, উত্তেজনা সহজে আয়ত্বে আনা যায় না এবং অকারণে হাত-পা ছোঁড়াছুড়ি করে। এই অবস্থাকে ক্যাটাটনিক সিজোফ্রেনিয়া বলে। শিশুদের স্মরণশক্তি কমে যাওয়া বা হঠাৎ করে কোন কিছু মনে করতে না পারা। যেমন হঠাৎ করে কোন নাম, সংখ্যা ইত্যাদি মনে করতে না পারা। এই অবস্থাকে রিটেনশন ডিফেক্টেড বলে। অনেক শিশুর শারীরিক রোগ নির্দেশ করে কিন্তু শরীরের কোন প্রকার যান্ত্রিক ত্রুটি পাওয়া যায় না। যেমন হাইপোকনডিয়্যাসিস বা কল্পিত রোগ সম্বন্ধে ভীতি। যা একটি মানসিক রোগ, একে সোম্যাটাফিম ডিজিজ বলে। কোন কোন শিশু এক প্রকার মানসিক ভ্রান্তিতে কষ্ট পায়। এক্ষেত্রে আক্রান্ত শিশুর প্রাথমিকভাবে এই জাতীয় কোন মানসিক ভ্রান্তি থাকে না। আক্রান্ত শিশুর কোন নিকটজন যখন প্রাথমিকভাবে মানসিক ভ্রান্তিতে কষ্ট পেয়ে থাকেন এবং পরবর্তীকালে ঐ শিশুটি তার দ্বারা প্রভাবিত হয়ে মানসিক ভ্রান্তিজনিত অবস্থায় কষ্ট পেয়ে থাকে। যাকে ইনডিউসড সাইকোটিক ডিসঅর্ডার  বলে।

শিশুরা এক প্রকার মানসিক আতঙ্ক ভুগে থাকে। এ জাতীয় আতঙ্কের পেছনে, আক্রান্ত শিশুর নিজের কিছু অভিজ্ঞতালব্ধ জ্ঞান থাকে যেমন- শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন, যুদ্ধ, প্রাকৃতিক কোন দুর্ঘটনা, ডেথক্যাম্প প্রভৃতি। ঐ জাতীয় ঘটনাগুলি শিশু সর্বদা চোখের সামনে দেখতে থাকে, ঘুমের মধ্যে দেখে থাকে, ফলে শিশু কিছুতেই ঘুমাতে পারে না, সর্বদা ঘটনার কথা মনে পড়ে। ঐ ঘটনায় যারা মারা যায় তাদের সঙ্গে বিচার করে রোগী নিজেকে অপরাধী বলে মনে করে কারণ সে বেঁচে আছে। এই জাতীয় অবস্থাকে পোস্ট ট্রম্যাটিক স্ট্রেস ডিসঅর্ডার বলে। বাড়ন্ত শিশুদের হওয়া একটি বিরল জাতীয় রোগ বিশেষ, এই রোগের ফলে মস্তিষ্ক বল্কলের স্নায়ুকোষের বিকৃতি, ক্রমশঃ বৃদ্ধিপ্রাপ্ত মানসিক অবনতি, বধিরতা, অন্ধত্ব ও শিশুর অকাল মৃত্যু ঘটে থাকে। যাকে পোলিওডিসট্রফিয়া সেরিব্রি বলে। অনেক শিশু-সন্তান শৈশব ও বয়ঃসন্ধিকালে কিছুতেই অন্যের অধিকার মেনে নিতে রাজি হয় না, সর্বদাই কাজেকর্মে একটা উগ্রতার ছাপ থাকে। বয়স অনুপাতে তার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য যে সামাজিক নিয়ম থাকে, তা কিছুতেই শিশু মানতে চায় না। এটা এক ধরনের মানসিক গোলযোগ, যাকে কনডাক্ট ডিসঅর্ডার বলে।

শিশু-সন্তানদের মধ্যে শৈশব বা বয়ঃসন্ধিকালের এক প্রকার গোলযোগ দেখা দেয়। এক্ষেত্রে শিশু তার সঙ্গে সম্পর্কিত নয় এইরূপ কোন বিষয় সম্বন্ধে অতিরিক্ত চিন্তিত বা ভীত থাকে। এই অবস্থাটিকে ওভারঅ্যাঙ্কশাস ডিসঅর্ডার বলে। বয়ঃসন্ধি শুরু হবার কিছুদিন আগে থেকে ছেলেমেয়েদের এ জাতীয় মানসিক বিকৃতির লক্ষণ দেখা যায়। তখন ছেলেমেয়েরা নিজের মাকে চিনতে পারে না। অন্যের সঙ্গে অসঙ্গত ব্যবহার করে থাকে এবং শারীরিক বৃদ্ধি সঠিকভাবে হয় না। এই অবস্থাটিকে চাইল্ডহুড সিজোফ্রেনিয়া  বলে। বয়ঃসন্ধিকালে অনেক সময় ছেলেমেয়েদের মধ্যে লজ্জাভাব দেখা যায় না, এবং নিজের সামাজিক দায়িত্ব সম্পর্কে জ্ঞানের অভাব দেখা যায় অর্থাৎ নিজের পরিচয় সম্পর্কে সন্ধিহান থাকে। এটি আসলে কোন একপ্রকার মানসিক গঠন সম্পর্কিত গোলযোগ। যাকে আইডেন্টিটি ক্রাইসিস বলে। বয়ঃসন্ধিকালের শেষ দিকে ছেলেমেয়েদের মধ্যে একপ্রকার মানসিক অবস্থা দেখা যায়। তারা সর্বদা নিজেদের ভবিষ্যত সম্বন্ধে আতঙ্কিত থাকে। নিজেদের ভবিষ্যতে কী হবে এই চিন্তায় সর্বদা চিন্তিত হয়ে থাকে। এই জাতীয় অবস্থাকে আইডেন্টিটি ডিসঅর্ডার বলে।

মানসিক স্বাস্থ্যের গুরুত্ব অপরিসীম। সহজ সরল ভাষায় একটি উদাহরণের মাধ্যমে বিষয়টি পরিষ্কার করা যাকঃ ধরা যাক, ‘ক’ নামের একটি বালক হিংস্র প্রাণী যেমন- কুকুর বা বাঘ দেখে ভয় পায় (তেলেপোকা দেখেও অনেকে ভয় পায়)। ‘খ’ নামের অন্য একটি বালক ভুত-প্রেতের কথা শুনলে ভয় পায়। ‘গ’ নামের আরেকটি বালক প্রাকৃতিক (সূর্য/চাঁদের আলো) কিংবা কৃত্রিম আলো (বৈদ্যুতিক/হারিকেন/চুলোর আলো) অথবা পানি দেখলে ভয় পায় বা আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়ে। এদিকে ‘ঘ’ নামের আরেকটি বালক বিমানে উঠতে ভয় পায় অথবা নাগরদোলায় বা সিঁড়ি দিয়ে নামতে ভয় পায়। উদাহরণের চারটিই ভীতির বিষয় কিন্তু সবগুলো এক ধরনের ভীতি নয়। প্রথম বালকের ভীতির জন্য চিকিৎসার প্রয়োজন নেই। দ্বিতীয় বালকের ভীতি বিষয়ে কাউন্সিলিং প্রয়োজন, যা মনরোগ বিশেষজ্ঞরা প্রদান করে থাকেন। যদিও আমাদের দেশের গ্রামাঞ্চলের মানুষ হুজুর, ফকির, কবিরাজের শরণাপন্ন হয়ে থাকেন এবং অনেক ক্ষেত্রে সফলতাও পান। তৃতীয় ও চতুর্থ ভীতির বিষয়ে চক্ষু বিশেষজ্ঞ, স্নায়ুরোগ বিশেষজ্ঞ এবং প্রযোজ্য অন্যান্য বিশেষজ্ঞের দ্বারা চিকিৎসা করা প্রয়োজন। অবশ্য, অনেক ক্ষেত্রে হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসাও কার্যকরী ভূমিকা রাখতে সক্ষম। যদি উপযুক্ত এবং দক্ষ হোমিওপ্যাথের পরামর্শক্রমে ওষুধ সেবন করা যায় তাহলে তা প্রারম্ভেই নিরাময় হয়।

শিশু ও বয়ঃসন্ধিকালের মানসিক স্বাস্থ্যের গুরুত্ব বিষয়ে প্রখ্যাত দার্শনিক ও চিকিৎসা বিজ্ঞানী জেমস টাইলার কেন্ট সুন্দর একটি দৃষ্টান্ত তুলে ধরেছেন। তিনি বলেছেন যে, ধরা যাক, একটি স্নায়ুপ্রবণ শিশু রাতে ভীতিজনক স্বপ্ন দেখে, কখনও কখনও তড়কা হয়, অস্থির নিদ্রা যায়, স্নায়বিক উত্তেজনা অথবা হিষ্টিরিয়ার নানা লক্ষণ তার মধ্যে দেখা যায়। এই অবস্থায় ঐ শিশুটির শরীরের সকল ধরনের পরীক্ষা করা হলে হয়তো তেমন কোন সমস্যাই ধরা পড়বে না। যেহেতু ঐ সমস্যাগুলো শরীরযন্ত্রের কোন ত্রুটির কারণে ঘটছে না। শুধুমাত্র সমস্যাগুলো প্রত্যক্ষ করা যাচ্ছে। কিন্তু শিশুটির এই উপস্থিত ত্রুটি/অসুস্থতা যদি আরোগ্য করা না হয়, তাহলে বিশ কিংবা ত্রিশ বছর পরে শিশুটির তন্তুগুলোর পরিবর্তন ঘটবে, তার দেহযন্ত্রগুলো রোগাক্লিষ্ট হবে। তখন হয়তো বলা হবে যে, শিশুটি সেই প্রথম অবস্থা থেকেই রোগাক্রান্ত ছিল। চিকিৎসায় ব্রতী হয়ে রোগের পরিণামগুলোই কী চিকিৎসক এবং আমাদের বিচার্য বিষয়। অসুস্থতার সূচনালগ্নে থেকে রোগের কারণ বিচার-বিশ্লেষণ করে চিকিৎসা আরম্ভ করা কী আমাদের কর্তব্য নয় কী!

পরিশেষে বলা যায় যে, শিশুদের স্নায়ুশক্তি সুনিয়ন্ত্রিত ও সুগঠিত নয়। তারা অতি সহজেই ভয় পায়, অভিভূত হয়। মাতৃগর্ভে ভ্রুণ সৃষ্টির সময় পিতা-মাতার তৎকালে বিদ্যমান মানসিক কিছু পরিস্থিতির খানিকটা জিনগতভাবে শিশুরা অর্জন করে থাকে। শারীরিক অনেক সমস্যা সব শিশুরা প্রকাশ করতে পারে না। তাই শিশুরা অনেক ধরনের মানসিক রোগে ভুগে থাকে। উপরে বর্ণিত সমস্যাগুলোর অধিকাংশই মনরোগ ও স্নায়ুরোগ বিশেষ। কিছু কিছু অসুবিধা স্বল্পতম সময়ে উপশম হয়, কিছু আবার বেশ সময় লাগে এবং কিছু সমস্যা দীর্ঘস্থায়ী হয়। যেগুলি উপশম পেতে সময় লাগে সেগুলোর বিষয়ে অভিভাবকদের চিকিৎসকের শরণাপন্ন হওয়া উচিত। তা না হলে পরবর্তী জীবনে শিশুরা দীর্ঘমেয়াদি সমস্যায় ভুগতে পারে।



রাইজিংবিডি/ঢাকা/৩ অক্টোবর ২০১৮/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়