ঢাকা     বুধবার   ২৪ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১১ ১৪৩১

দেবী আনন্দময়ী || সঞ্জয় সরকার

সঞ্জয় সরকার || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৯:৩৯, ২৪ সেপ্টেম্বর ২০১৭   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
দেবী আনন্দময়ী || সঞ্জয় সরকার

হিন্দু সম্প্রদায়ের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় উৎসব শারদীয় দুর্গাপূজা। তবে বর্তমানে এ পূজা শুধু হিন্দুদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়, এর মধ্য দিয়ে জাতি, ধর্ম, বর্ণ- নির্বিশেষে সকলের মধ্যেই সৌহার্দ্য-সম্প্রীতি ও মৈত্রীর বন্ধন গড়ে ওঠে। শরৎকালের এ উৎসব সকল বাঙালির হৃদয়ে বয়ে আনে অনাবিল আনন্দ। তাই কালের ধারাবাহিকতায় সনাতন ধর্মাবলম্বীদের শারদীয় দুর্গোৎসব এখন সর্বজনীন দুর্গোৎসবে পরিণত হয়েছে।

দেবী দুর্গা শুধু এক নামেই পরিচিতা নন। বিভিন্ন শাস্ত্রে তিনি ভগবতী, চণ্ডী, উমা, পার্বতী, আদ্যশক্তি মহামায়া প্রভৃতি নামে পরিচিতা। নারী রূপে আবির্ভূতা হলেও আসলে তিনি নারী বা পরুষ কোনোটাই নন। তিনি এক অভিন্ন সত্তা বা মহাশক্তি। সকল দেব-দেবীর সমন্বিত পরমাশক্তি। তিনিই আবার মহাকালী, মহালক্ষ্মী, মহা সরস্বতী, নারায়ণী নামে আরাধিত। তিনি বহুরূপিনী দেবী। যুগে যুগে বিভিন্ন সঙ্কটের মুহূর্তে জীব ও জগতের কল্যাণের লক্ষ্যে তিনি বহু রূপে বা নামে মর্ত্যধামে আবির্ভূত হয়েছেন। আসলে তিনি আদি শক্তি, ব্রহ্ম সনাতনী। শক্তি অর্থে ব্রহ্মার মহাশক্তিকে বোঝায়। যা থেকে বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ডের উদ্ভব। এ শক্তি অনাদি, অনন্ত। সর্বব্যপী তিনি বিস্তৃত। তাই তিনি জগজ্জননী। সকল দুর্গতি বিনাশ করেন বলে তিনি দুর্গতিনাশিনী। আবার ভক্তের কাছে অপার আনন্দের পসরা নিয়ে আবির্ভূত হন বলে তিনি মা আনন্দময়ী। দুঃখকে নাশ করেন বলে তিনি দুর্গা। আবার অনেকের মতে, দুর্গ নামে এক দৈত্যকে বধ করার মধ্য দিয়েই তিনি দুর্গা নামে খ্যাত হন। শত্রুর কাছে তিনি ভয়ংকরী, সংহাররূপিনী। আবার ভক্তের কাছে স্নেহময়ী জননী, কল্যাণপ্রদায়িনী।

পুরাণ থেকে জানা যায়, ত্রিলোকের ত্রাস ও অত্যাচারী দৈত্য সম্রাট মহিষাসুর বধ করার জন্যই দৈবী দুর্গার আবির্ভাব ঘটেছিল এই মর্ত্যলোকে। ঘটনার বর্ণনা এরকম: স্বর্গরাজ ইন্দ্রকে যুদ্ধে পরাজিত করেছিলেন মহিষাসুর। কারণ, তিনি ছিলেন ব্রহ্মার বরপ্রাপ্ত। স্বর্গরাজকে পরাজিত করার পর দেবতাদের তাড়িয়ে সেখানে একচ্ছত্র আধিপত্য বিস্তার করে অসুরের দল। দেবতারা চলে আসেন মর্ত্যলোকে। কিন্তু এখানেও শুরু হয় মহিষাসুরের অত্যাচার-নির্যাতন। অসুর সম্রাট তার আসুরিক প্রভাবে স্বর্গ, মর্ত্য, পাতাল সবখানেই পাপের রাজত্ব প্রতিষ্ঠা করতে শুরু করে। নিরুপায়ে দেবতারা শেষ পর্যন্ত আদ্যশক্তি মহামায়ার স্মরণ করেন। তখন মহামায়ার নির্দেশে এবং ক্রুদ্ধ দেবতাদের দেহনিঃসৃত সম্মিলিত তেজরশ্মি থেকে আবির্ভূত হন এক অগ্নিগর্ভা, রূপবতী ও তেজস্বীনি দেবী। তিনিই আমাদের পরামারাধ্য দেবী দুর্গা। মহা পরাক্রমশালী অসুরকে যুদ্ধে পরাজিত ও বধ করে তিনি দেবগণের রাজত্ব উদ্ধার করেন।

অসুরকে বধ করেছিলেন বলে দুর্গার আরেক পরিচয় ‘মহিষাসুর মর্দিনী’। এ অসুর ছিল মূলত প্রবল অশুভ রিপুর প্রতীক। তাই দেহের, মনের ও সমাজের অশুভ রিপু বা পশু শক্তিকে বিনাশ ও শুভ শক্তির উন্মেষের কামনায় দেবী দুর্গার আরাধনা করা হয়।

দুর্গা পতিগৃহ কৈলাসে থাকেন। বছরের তিন ঋতুতে তিনি তিন রূপে মর্ত্যে আবির্ভূত হন। যেমন, শরতে শারদীয় দুর্গা, বসন্তে বাসন্তী দুর্গা এবং হেমন্তে কাত্যায়নী দুর্গা। তিন ঋতুতেই ভক্তরা তাঁকে পূজা করেন। তবে বর্তমানে সবচেয়ে বেশি জনপ্রিয় হচ্ছে শারদীয় দুর্গাপূজা। ত্রেতা যুগের কোনো এক শরৎ ঋতুতে শ্রী রামচন্দ্র রাবনকে বধ ও সীতাকে উদ্ধার করার জন্য একশ আটটি নীল পদ্ম দিয়ে দেবী দুর্গার পূজা করেছিলেন। অকালের এই পূজার জন্য একে দেবীর অকাল বোধনও বলা হয়। বছরের এই সময়ে তিনি সপরিবারে পৃথিবীতে বেড়াতে আসেন। এ সময় দুর্গার অধিষ্ঠানে থাকেন তাঁর চার সন্তান ধন-সম্পদের প্রতীক লক্ষ্মী, জ্ঞান-বিদ্যার দেবী সরস্বতী, সিদ্ধিদাতা গণেশ ও শৌর্যবীর্যের প্রতীক কার্ত্তিক। যেন পৃথিবীর জন্য এক মহা আয়োজন। সকলের উদ্দেশ্যই এক। তা হলো জীব ও জগতের সুখ, শান্তি এবং অসুর-অশুভের বিনাশ। তাই প্রতিমার কাঠামোতেও দুর্গার পদতলে পদদলিত অবস্থায় থাকে অসুররূপী দানব। সিংহের ওপর দাঁড়ানো দেবীর দশহাতে থাকে দশ অস্ত্র- ত্রিশূল, খড়গ, চক্র, বান, শক্তি, ঢাল, ধনু, পাশ, অংকুশ ও কুঠার। দশ হাতে দশ দিক রক্ষা করে চলেন তিনি। এ জন্যই তাঁকে বলা হয় দশভূজা।

প্রতিবারের মতো এবারও মহা সমারোহে অনুষ্ঠিত হচ্ছে শারদীয় দুর্গোৎসব। এক সময় হিন্দু জমিদার বা ধনী ব্যক্তিরা দুর্গাপূজার আয়োজন করতেন। তবে দেবীর আরাধনার চেয়ে সমাজে প্রভুত্ব বিস্তারই ছিল তাদের অনেকের মূল লক্ষ্য। কিন্তু কালক্রমে দুর্গোৎসবকে সর্বজনীন রূপ দিয়েছে বাঙালিরা। দুর্গাপূজা এখন আর কেবল একটি বিশেষ শ্রেণির পূজা নয়। এর মধ্য দিয়ে হাজারো বছরের জাত-পাতের বিভেদ চুরমার করে তথাকথিত উচু-নিচুর মধ্যে রচিত হয়েছে এক মহা ঐক্যের ভীত। তাই পূজা উপলক্ষে জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকলেই সৌহার্দ্য-সম্প্রীতি ও ভালবাসার এক অকৃত্রিম বন্ধনে মিলিত হয়।

শক্তিরূপিনী, অসুরবিনাশী দেবী দুর্গা সর্বদাই স্নেহময়ী জননী, কল্যাণপ্রদায়িনী মা। জীব ও জগতের কল্যাণ সাধনই তার উদ্দেশ্য। তাই দেবীর পূজা মানে শুধু ফুল-মাল্যের নৈবেদ্য নয়, বরং তাঁর উদ্দেশ্য অর্জনে কাজ করাই হবে আমাদের সত্যিকার পূজা।

অসুর-রিপুর প্রভাব থেকে এখনও মুক্ত হতে পারিনি আমরা। এখনও বিশৃঙ্খলমুক্ত হয়নি আমাদের সমাজ। লোভ-লালসা, হিংসা-বিদ্বেষ, দুর্নীতির কারণে সমাজ এখনও ক্ষত-বিক্ষত, জনজীবনে চরম দুর্গতি। সর্বত্র মূল্যবোধের অবক্ষয়। অমঙ্গলের ঘণ্টা বেজেই চলেছে প্রতিনিয়ত। তাই মা দুর্গার আশীর্বাদে আমাদের দেহ-মন বিশুদ্ধ হোক, সত্য-সুন্দরের আলোয় আলোকিত হোক পৃথিবী, সবখানে ছড়িয়ে পড়ুক শান্তি-সুখের বারতা; দেবীর কাছে এই হোক আমাদের বিনম্র প্রার্থনা।

লেখক: সাংবাদিক, ছড়াকার




রাইজিংবিডি/ঢাকা/২৪ সেপ্টেম্বর ২০১৭/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়