ঢাকা     বৃহস্পতিবার   ১৮ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৫ ১৪৩১

কলকাতার পুজো || অভিজিৎ মুখার্জি

অভিজিৎ মুখার্জি || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০২:০৮, ২৮ সেপ্টেম্বর ২০১৭   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
কলকাতার পুজো || অভিজিৎ মুখার্জি

প্রয়াত সাহিত্যিক নবারুণ ভট্টাচার্য একবার ওঁর পত্রিকার আপিসের আড্ডায় বলেছিলেন, দক্ষিণের না হয় ভরতনাট্যম আছে, কথাকলি, কুচিপুরি আছে, উত্তরের আছে কত্থক, উড়িষ্যার ওড়িষী, মণিপুরের মণিপুরি, ভাসানের লরিতে উঠে শিস দিতে দিতে কবজি ভাঁজ করে কোমরে আর মাথায় রেখে কোমর দোলানো ছাড়া কলকাতার আছেটা কী?

লঘু পরিবেশে এই নিয়ে খানিক হাসাহাসি হলো তারপর, কিন্তু কথাটা আমার মনে রয়ে গেল। ঠিকই তো, ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের যে নাচ শিখতে পাঠানো হয়, সেখানে তো আর কেউ পুরুলিয়ার ছৌ নাচ শিখতে যায় না, বাকি ভারতের যে নৃত্যশিল্পের ঐতিহ্য সেগুলোরই চর্চা করতে যায়। অথচ কলকাতায় কালচার বলে একটা জিনিস থাকতেই হয়, আমাদেরই দায়িত্ব সেটা। ওটা না থাকলে তো কলকাতার কথা উঠলে মাদার টেরেসার সেবাকেন্দ্র ছাড়া বাইরের লোকের আর কিছু মনেই পড়বে না। ঠিক আছে, ভাসানের লরিতে নাচই সই, কী উপলক্ষে ভাসান সেটা মনে করলেই হলো। কলকাতার অতুলনীয় পুজো আর পুজো কালচার!

প্রত্যেকটি সংস্কৃতির একটা কার্য-কারণের যোগসূত্র থাকে অর্থনীতির সঙ্গে, একথা জগৎ এখন মেনে নিয়েছে। কলকাতার যাবতীয় সাবেকি আড়ম্বরের ভিত্তিতে আছে মূলত চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের অব্যবহিত পরেই যা ঘটেছিল সেই পরিস্থিতি। জমিদারেরা ইংরেজের হাতে জমি সঁপে দিয়ে ক্ষতিপূরণ হিসেবে প্রচুর টাকাপয়সা হাতে পেয়ে কলকাতায় এসে উঠলো, এবং শুরু হলো নানা ফূর্তির সমারোহ- বেড়ালের বিয়ে, পায়রা ওড়ানোর প্রতিযোগিতা ইত্যাদি। এছাড়াও অর্থাগমের যে উপায়টি ছিল সেটা হলো, কলকাতা বন্দর থেকে ইংরেজদের জাহাজে রসদ সাপ্লাই। মূলত আফিমের, সঙ্গে অন্য কিছু পণ্য রপ্তানির ব্যবসা করে ইংরেজের সমুদ্রপথে বাণিজ্যে তখন অঢেল মুনাফা। হ্যাঁ, একথাও ঠিক যে সেই উদ্বৃত্ত অর্থের দাক্ষিণ্যে পাশাপাশি গড়ে উঠছিল পশ্চিমী জ্ঞান-বিজ্ঞান শিক্ষার কিছু কিছু সুযোগ, এবং সেই সচ্ছল নগরবাসীদের একটা খুব ক্ষুদ্র অংশ সেই সুযোগ কাজে লাগিয়ে চিন্তার ক্ষেত্রে বেশ খানিকটা অগ্রগতির নজিরও রেখেছিলেন বৈকি। কিন্তু জনজীবনের জীবনদর্শনে যে তার প্রায় কোনো প্রভাবই পড়েনি, সেও তো ঐতিহাসিক সত্য। রবীন্দ্রনাথের মৃতদেহ যখন দাহর জন্য শ্মশানে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল, তখন রাস্তায় মানুষের ঢল নামে এবং শোকগ্রস্ত মানুষ তাঁর চুল দাড়ি উপড়ে স্মৃতিচিহ্ন সংরক্ষণে এমন আবেগাপ্লুত তৎপরতা দেখায় যে, মৃতদেহ শ্মশানে পৌঁছোবার পরে, তা দেখে সেই মানুষটি বলে চিনে নেওয়া মুশকিল হয়ে পড়েছিল! অর্থাৎ সেই তখনও ফূর্তির আড়ম্বর আর রুচিশীল সংস্কৃতিচর্চার মধ্যে যোগসূত্র ছিল খুবই ক্ষীণ, প্রায় ছিল না বললেই চলে।

স্যর ভি.এস. নাইপল তাঁর ‘মিলিয়ন মিউটিনিজ নাউ’ বইতে জনসমক্ষে রবীন্দ্রনাথের শেষ ভাষণ ‘সভ্যতার সংকট’ সম্বন্ধে মন্তব্য করতে গিয়ে এক জায়গায় বলেছেন, কবি বেঁচে থাকলে দেখতেন, ইংরেজ চলে যাওয়ার কয়েক বছরের মধ্যেই কিভাবে তাঁর নিজের শহর কলকাতা একটি ভূতুড়ে ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে।  ইংরেজ নেই, তার তৈরি বন্দর পরিত্যক্ত প্রায়, চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের পয়সা সেই কবেই উড়িয়ে দেওয়া গেছে, ফলত ফূর্তির অর্থনীতি তার একেবারে উৎসেই গেছে আমূল বদলে। কলকাতা শহর এখন সামান্য বিস্তৃতি পেয়ে, কার্যত বহুলাংশে একটি প্রোমোটার সৃষ্ট বসতি। কলকাতার কিছু কিছু মহল্লায় জনসংখ্যা কমছে, বাড়ি তালাবন্ধ পড়ে থাকছে, কারণ উচ্চ পেশাদারি কর্মসংস্থানের অনুপযোগী এই শহর ছেড়ে চলে যাচ্ছে অর্থনৈতিকভাবে উচ্চাকাঙ্ক্ষীরা পরিবারেরা- প্রথমে শহর ছাড়ছে শিক্ষা ও কর্মোপলক্ষ্যে তরুণ-তরুণীরা, কিছু পরে একটু স্থিতিশীলতা এলে নিয়ে যাচ্ছে আগের প্রজন্মকে। এমনিতেই এ শহরের এখন আরেক নাম- দ্য সিটি অব পেনশনার্স। ছোট ছোট ফ্ল্যাটে বাস করা কিছু, বস্তুতপক্ষে নিম্নমধ্যবিত্ত, পেশাদারি দক্ষতার ও জগত সম্বন্ধে দৃষ্টিভঙ্গি এবং মানসিকতার দিক থেকে বহু দশক ধরে অপরিবর্তীত উদ্বাস্তু কলোনির মানুষজন এবংবহুলাংশে নিয়মিত উপার্জনহীন মানুষদের ঠিকানা, বিচরণভূমি। এক ধরণের ক্ষ্যামাঘেন্নার ভর্তুকিতে চলা খুব নিম্নমানের শিক্ষাব্যবস্থার ফসল এরা, সেই শিক্ষার প্রসাদে না সাংস্কৃতিক ভাবে যুক্ত হওয়া যায় বাকি পৃথিবীর সঙ্গে (এমনকি আজকের বিশ্বায়িত পৃথিবীতেও), না জীবনধারণের জন্য প্রয়োজনীয় উপার্জনের ব্যাপারে আত্মবিশ্বাসী হওয়া যায়।

সংস্কৃতিবান মানুষের হয় বিনোদন এবং তা চর্চাসাপেক্ষ; সংস্কৃতিহীন, ইতিহাস বিচ্ছিন্ন মানুষের বিনোদন গভীরতাবর্জিত। এর আগে বারবারই ‘ফূর্তি’ কথাটা ব্যবহার করেছি বটে, যে আধুনিক আখ্যায় একেবারে নিখুঁতভাবে কলকাতার অধিকাংশ মানুষের বিনোদনের চরিত্রকে প্রকাশ করা যায়, তা হলো ‘ফান’! যার সঙ্গে মনস্তাত্ত্বিক দিক থেকে সাবল্টার্নের বাখতিন বর্ণিত ‘কার্নিভ্যালেস্ক’ বিনোদনের অনেকটাই যোগ আছে। যদি বিনোদনের গভীরতার মাপকাঠি খুঁজতে উনবিংশ শতকের ইংরিজি শিক্ষায় শিক্ষিত, সৃষ্টিশীল ও অভিজাত সংস্কৃতিকেই তার চরম নিদর্শন বলে মনে করি, তাহলে একটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক পরিবর্তনের কথা কিন্তু মাথায় রাখতে হবে। উনবিংশ শতকে ইংরেজ শাসিত ভারতবর্ষের ভারতীয় হিসেবে কলকাতার সংস্কৃতি ও জ্ঞানবিজ্ঞান চর্চা অকুণ্ঠভাবে হাত বাড়িয়ে দিয়েছিল ভারতবর্ষের বৈচিত্রসমৃদ্ধ ঐতিহ্যের দিকে, কলকাতার অভিজাত বাঙালির সৃষ্টিশীলতার পিছনে অবলম্বন হিসেবে যে আইডেনটিটি কাজ করছিল তা ঐতিহাসিকভাবে ভারতীয়। আজকের পঃবঙ্গের রাজনীতির যে চরিত্র, দেখেশুনে মনে হয়, তার প্রত্যক্ষ ও অবশ্যম্ভাবি পরিণতিতে বাঙালি সংস্কৃতিগতভাবে সংগঠিত হয়েছে ভারতবর্ষকে কার্যত অস্বীকার করতে। একশ বছর আগের ও পরের বিনোদনের প্রেক্ষাপট প্রায় সম্পূর্ণতই সম্পর্কবিহীন। আজকের কলকাতার উৎসবের (মূলত যা ‘ফান’ আরকি) সঙ্গে ইতিহাসের যোগ খুবই ক্ষীণ, এ জিনিস কোনো উত্তরাধিকার নয়।

ভারতের গণতন্ত্রও তৃতীয় বিশ্বের আর পাঁচটা দেশের মতই, নির্বাচনে জয়ের জন্য পেশিশক্তি অপরিহার্য এবং পেশিশক্তির অধিকার ও ক্ষমতা প্রচ্ছন্নভাবে মান্যতা পেয়েই গেছে সমাজে। রাজনৈতিক নেতা ও তার পেশিশক্তিস্বরূপ যেসব কৃতি ব্যক্তির আঞ্চলিকভাবে সমাজে রমরমা, তারাই কলকাতার সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্রের প্রতিনিধিত্ব করা এইসব বিপুল বাজেটের বারোয়ারি পূজার উদ্যোক্তা। সারাবছর খাওয়া পরার, হাতখরচের টাকার যোগান এই পবিত্র ও মহান কর্মযজ্ঞের মাধ্যমে সুনিশ্চিত করাই এখন পুজোর প্রাথমিক অর্থনীতি। প্রত্যেকটি পরিবার থেকে চাঁদা তোলা, বিজ্ঞাপণ কম্পানির থেকে প্রাপ্তি, এগুলোই অর্থাগমের মুল উৎস। এর থেকে কিছু কিছু মূর্তি গড়ার কারিগর, মণ্ডপসজ্জার কারিগর, ভলান্টিয়াররা তো পায়ই, সঙ্গে ছোট ছোট খাবারের স্টল, প্রসাধনের সামগ্রীর স্টল, মাইক ভাড়া দেওয়ার ব্যবসা যাদের তাদেরও কিছু উপার্জন হয় বইকি। শিক্ষার অভাবে ও কুশিক্ষার ফলে উদ্ভূত সর্বব্যাপী অকর্মণ্যতা শহরের মানুষের গড়পড়তা ক্রয়ক্ষমতাকে যেখানে নামিয়ে এনেছে তার উর্দ্ধসীমাকে উৎসবের অভ্যাসের সংস্কার ঠেলে একটু হলেও ওপরে তুলতে পারে, সেটাও অনেকের কাছে এ ক’দিনের জন্য কিছুটা উপার্জনের উপায়। এ শহরে বহু মানুষের কাছেই এক্সট্রা উপার্জনই একমাত্র উপার্জন!

‘কালেকটিভ সাবকনশাস’ অর্থাৎ যৌথ অবচেতন জিনিসটার ধারণা দিয়েছিলেন মনোবিজ্ঞানী কার্ল গুস্তাফ ইয়ুং। কলকাতার ও শহরতলীর বাঙালির যৌথ মনস্তত্ত্ব পৃথিবীর মনোবিজ্ঞানীদের নিবিষ্ট গবেষণার এক চমৎকার বিষয় হতে পারত, শহরটার কথা যদি বাকি পৃথিবীর খেয়াল থাকত। কী যেন একটা অব্যক্ত সংকটে, একটা অব্যক্ত লাঞ্ছনাবোধে মরীয়া জেদ চেপে গেছে বাঙালির! দাঁতে দাঁত চেপে, চোয়াল শক্ত করে, বুকে চাপড় মেরে জগতের কাছে (আসলে নিজেদেরই কাছে) ঘোষণা করতেই হবে, দ্যাখো এই আমাদের উৎসবে আমরা কত খুশি। নিজেদেরই যাবতীয় বোধের সঙ্গে লড়াই করে ছিনিয়ে আনা এই খুশি, এ আমাদের জয়, কে বলেছে আমরা সব প্রতিযোগিতায় হেরে গেছি দশকের পর দশক! পুজোর সাতদিন আগে অর্থাৎ মহালয়ার দিন থেকেই বাঁশ দিয়ে রাস্তাঘাটকে বিভাজিত করে কিংবা একেবারে আটকে দিয়ে সারা শহরকে একটি নিখুঁত খোঁয়াড়ের রূপ দেওয়া হয়। এবং সেই ব্যবস্থাকে নৈতিক বৈধতা দিতে পঞ্চমীর দিন থেকেই পিলপিল করে (দলে দলে লিখলে ছবিটা অন্যরকম তৈরি হতে পারে, যারা প্রত্যক্ষদর্শী নয় তাদের কাছে) মানুষ কোথা থেকে কোথা থেকে কলকাতার রাস্তায় ভাসমানভাবে ঘুরে বেড়িয়ে শহরের দখল নিয়ে নেয়। পিলপিল করে বেরিয়ে পড়ে সেই মুখগুলো যারা নিজেরাই নিজেদেরকে পরস্পর ব্যঙ্গ করে, গাল পেড়ে, নির্যাতন করে, ঠকিয়ে, এ ওরটা কেড়ে নিয়ে প্রতিনিয়ত হেনস্থা করার ও হওয়ার জীবনে, নিজেদের ছোট ছোট গণ্ডীর মধ্যে, উপায়হীনভাবে আবদ্ধ থাকতে বাধ্য হয় উৎসবহীন বছরের বাকি দিনগুলোতে। ধীরে ধীরে তাই উৎসবের সংখ্যা বাড়ছে, সারাবছরই যাতে কিছু উপলক্ষ তৈরি করে নেওয়া যায় গভীর গ্লানি আর হতাশার থেকে মনটাকে কিছুটা হলেও রেহাই দেওয়ার চেষ্টা করতে। এর একটা বড়ো অংশ আসে শহরতলী থেকে, ট্রেনে করে মফস্বল থেকে। শহরের মানুষও কিছু যোগ দেয় এই খোঁয়ার পরিক্রমায়, বাকিরা নৈতিক চীয়ার-লিডার হিসেবে বাড়িতে বসে টেলিভিশনের পর্দায় ভিড় দেখে। তবে কিনা, বাঙালি মাত্রেই আপোষহীন যোদ্ধা তো, তার স্বাধীনতা আন্দোলনের ইতিহাস, তার নকশাল আন্দোলনের ইতিহাস, ইংরিজি তুলে দিয়ে ঔপনিবেশিক জ্ঞানের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের ইতিহাস তো সে ভুলে যায়নি। তাই অনেক সম্পন্ন পরিবারও একদিন বেরোয় গাড়ি ভাড়া করে, কিংবা নিজেদের গাড়িতে সারারাত ধরে ঠাকুর দেখতে।

আচ্ছা, ঠিক কী দেখে এরা? মোটামুটি একই রকম মূর্তি প্রতিবছর সব মণ্ডপে। মূর্তি গড়ার আর্ট? কই, কলকাতার কোনো কাগজে, অত অত ক্রোড়পত্রের কোথাও তো সেই আর্ট নিয়ে তেমন কোনো প্রতিবেদন থাকে না! পুজোর বাকি ক’টা দিন সে বুরবোঁ ফ্যামিলির সুরা-সাধক। ওই একদিন সে স্বয়ং নেপোলিয়ন কাম তেনজিং নোরগে! বেঢপ শরীরের মধ্যপ্রদেশে চরের মতো জেগে ওঠা ভুঁড়ি, কাঁধের কাছ থেকে লম্বালম্বি কাটা গলার উনবিংশ শতকীয় চাপকান পরে সে-ই কালীপ্রসন্ন সিংহ! বোসপুকুর থেকে বাবুবাগান হয়ে সঙ্ঘশ্রী ক্লাব আর পঁচিশ পল্লীর পুজোর প্যাণ্ডেলে প্যাণ্ডেলে সে সাক্ষাত লিভিংস্টোন! সঙ্গে বৃদ্ধা মা, প্রৌঢ়া দিদিকেও নেয় অশ্বমেধের ঘোড়ার সম্মানের ভাগে বঞ্চিত না রাখতে। এবেলা-ওবেলা উন্মত্ততার এবোলা ভাইরাসের সংক্রমণ রোধিবে কে! সরকারি ক্ষমতাসীন দলও তখন সমাজসেবায় রিক্রুট করতে থাকে শহরতলী থেকে, মফস্বল থেকে মহা পরাক্রান্ত ভলান্টিয়ার, ষোলো থেকে কুড়ির মধ্যে বয়েস। এই উপলক্ষে ভলান্টিয়াররা পায় শৃঙ্খলারক্ষী বাহিনীর খাকি ইউনিফর্ম, টুপিতে সুতো দিয়ে লাল ফুল। আর, সবচেয়ে বড়ো কথা হাতে হাতে একটা করে লাঠি ও তার যথেচ্ছ প্রয়োগের অধিকার। আর তাদের পায় কে? কে বলেছে বাঙালি কর্মবিমুখ, দায়িত্ব পালনে নিষ্ঠাহীন? বাঁশের বেড়ার গোলক ধাঁধায় একবার পথ ভুল করে বেপথু হয়ে গেলে আবালবৃদ্ধ বনিতাকে সেই লাঠি দিয়ে ছপটি মারার মতো করে পায়ে বাড়ি দিয়ে সমাজকে সুশৃঙ্খল রাখার কাজে সেই কী উল্লাস তখন ষোলো থেকে কুড়ির! এতদিন ইস্কুলের মাষ্টার, পাড়ার দাদা, হতাশায় বেপরোয়া পিতামাতা যতবার আঘাত করে নির্যাতন, লাঞ্ছনা করেছে তাকে, তা সুদে আসলে উসুল করে নেওয়ার এই স্বর্গসুখে ভরা সন্ধ্যায় তারা মাতোয়ারা হয়ে ওঠে। বাস বা অন্য পরিবহণ রাস্তায় বিশেষ থাকে না, ক্কচিৎ এসে পড়লেও কোনো এক অজ্ঞাত কারণে সেগুলোকে নির্দিষ্ট স্টপে দাঁড়াতে না দিয়ে কেবলি বাসের গায়ে লাঠির বাড়ি মেরে মেরে সম্ভাব্য যাত্রীদের (যদি এমন কোনো অসামাজিক নির্বোধ সেই উদ্দেশ্যে বাস স্টপে হাজির থাকে আদৌ) চূড়ান্ত হয়রানি করে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয় পুলিশের দায়িত্ব কত জটিল, কত নিশ্ছিদ্র তাদের প্রস্তুতি সেই দায়িত্ব পালনে। হ্যাঁ, যদি কেউ অসুস্থ হয়ে পড়ে হঠাৎ করে, হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার প্রয়োজন হয়, কিংবা পুজোর দিনগুলোর মধ্যে হাসপাতাল থেকে বাড়ি ফেরার হয়, কোনো নিশ্চয়তা নেই, শত চেষ্টাতেও সেকাজ করে ওঠা যাবে কি না। বিকেলের দিকে আত্মীয়স্বজনের বাড়ি গিয়ে গল্পগুজব করবেন বলে ভাবছেন? ভিড় ঠেলে পাড়ার মোড়ে পৌঁছে নিন আগে, তারপর বাস ট্রামের পরিস্থিতি বুঝে নিয়ে ফিরে আসুন। আর আছে লাউড-স্পীকার! পৃথিবীর কোনো সভ্যদেশের মানুষ কল্পনা করতে পারে এই নির্যাতন? সাত, আট দিন ধরে লাউড-স্পীকারের শব্দে আপনি আপনার নিজের পছন্দ মতো কোনো গান শুনতে পারবেন না, ফোন এলে ফোনে কথা বলতে পারবেন না, বাড়ির মধ্যে একে অন্যের কথা শুনতে গেলে মুখের কাছে কান নিয়ে গেলে ভালো হয় এমন অস্থির অবস্থা হয়! আত্মপরিচয়হীন, উপার্জনহীন, শিক্ষাহীন তরুণেরা কি দিনে, কি রাতে হাতে মাইক্রোফোন পেলে সারা পৃথিবীকে জানান দিতে চায় যে সেও আছে, তাকে যেন ভুলে না যায় কেউ! হ্যালো, হ্যালো হ্যালো... প্রথম মাইক্রোফোনটি হাতে পেয়েই টানা বারো কি চোদ্দবার হ্যালো না বললে মনে হয় কেউ ওর কণ্ঠরোধ করে ধরেছে।

সেদিন ফেসবুকে দেখলাম কা’রা লিখেছে, বাঙালির পুজোর সঙ্গে ভারতের হিন্দুধর্মের কোনো যোগ নেই, এ আমাদের লোকায়ত উৎসব। এক্কেবারেই। তবে মনে হয় কথাটা অন্য কোথাও থেকে শোনা, এরকম কথা উঠছে হয়তো। অসুবিধে কেবল ওই মহালয়ার দিনে মহিষাসুরমর্দিনী নিয়ে। সংস্কৃতে চণ্ডীপাঠটা বাঙালির লোকায়ত বলে চালানোটা মুশকিল হবে। গামছা পরে ভেলায় চেপে মাছ ধরতে ধরতে চণ্ডীপাঠ, একমাত্র সাহেবদের বানানো সিনেমায় থাকতে পারে। কিন্তু এই লোকায়ত রগড়টা রাস্তার ওই পিলপিলিয়ে চারিদিকে ছড়িয়ে পড়া লোকেদের প্রয়োজন। সমাজজীবনে নৈতিকতা, সৌহার্দ্য, পারস্পরিক বিশ্বাস, শিষ্টতার যে চিত্র, তাতে উৎসবের ডামাডোলের ক'দিন ঐ কলেপড়া ইঁদুরের জীবন থেকে ওদের মুক্তি, এতবড় শহরে ওদের কেউ চেনে না, কোনো পূর্ব-পরিচয়ের নির্মম বেড়াজাল ওদের ঘিরে নেই তখন। এদের লাঠি দিয়ে মারা যায়, বাপ্-মা তুলে অপমান করা যায়, ঘাড় ধাক্কা দেওয়া যায় অনায়াসে, এদের মুখে চোখেই তার আমন্ত্রণ। এই এদের অশ্লীল অস্তিত্বকে পুঁজি করেই গড়ে উঠেছে লুম্পেনদের সার্বজনীন পুজো ও তাদের যথেচ্ছাচার। এই না-মানুষগুলোর প্রশ্রয়েই এইসব পুজোর উদ্যোক্তারা অধিকার সচেতন নাগরিককে হেনস্থা করার সাহস পায়, সমস্ত পৌর-আইন অমান্য করার সাহস পায়, সমস্ত দূষণ-রোধ কবিধিকে অগ্রাহ্য করে। অথচ কোথাও এই নিয়ে কারুর মুখে একটি প্রতিবাদ নেই, সারস্বত সমাজের মুখে কুলুপটি, কতগুলো লোক লেখক, কবি, গায়ক, মঞ্চাভিনেতা, চিত্রকর সেজে এইসব পুজোয় ভাঁড়ের মতো ছবি তুলিয়ে ভাঁড়ের মতো খুশির দূত সাজে। কেননা প্রতিবাদ করতে বড় দলের উস্কানি লাগে, ভবিষ্যতে অনধিকারের সম্মান ও স্বীকৃতির প্রলোভন লাগে, বড় দলের গড়ে দেওয়া ফোরাম লাগে, আর লাগে সংবাদপত্রের মিথ্যাচারের ঠেকনা।

এই কি মানুষের পরিচয়- বলে প্রশ্ন তুললে তার উত্তর দেওয়ার দায় ওদের নয়। আত্মঘাতী বাঙালীর যে পরিণতি নীরদ সি চৌধুরী তাঁর অন্তর্দৃষ্টি দিয়ে বুঝতে পেরেছিলেন, এই পিলপিলানোরা, এই অসহায়, অনুগ্রহসন্ধানী সারস্বত সমাজ তার শিকার। বাঙালি সমাজকে কোনো যাদুবলে আবার স্বাভাবিক, সৃজনশীল, শিষ্ট ও আত্মবিশ্বাসী হয়ে উঠতে গেলে, প্রথমেই বিলোপসাধন করতে হবে এই বর্তমান বারোয়ারি পুজোর নারকীয় প্রথার ও প্রদর্শনীর।

 


রাইজিংবিডি/ঢাকা/২৮ সেপ্টেম্বর ২০১৭/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়