ঢাকা     শুক্রবার   ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৬ ১৪৩১

মহালয়ার ভোর || অমর মিত্র

অমর মিত্র || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০১:৫৬, ৮ অক্টোবর ২০১৮   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
মহালয়ার ভোর || অমর মিত্র

সেদিন অমাবস্যা। পিতৃপক্ষ শেষ হচ্ছে। পরদিন থেকে দেবীপক্ষ আরম্ভ। আমার বাবা ভাদ্রমাসের পূর্ণিমার পর কৃষ্ণপক্ষ শুরু হলে পিতৃতর্পণ আরম্ভ করতেন। অমাবস্যার দিনে, মহালয়ার দিনে গঙ্গার ঘাটে গিয়ে সেই তর্পণ শেষ হতো। মহালয়ার সঙ্গে আমাদের পরিবারের একটি সম্পর্ক রয়েছে। দেশভাগের পর এপারে এসে আমাদের পরিবার যে প্রথম মৃত্যু দ্যাখে, তা এই অমাবস্যা কিংবা চতুর্দশী ও অমাবস্যার সন্ধিক্ষণে। সেই রাত্রি ফুরোলে আমরা জিইসি রেডিওতে শুনব বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের কণ্ঠে চণ্ডী পাঠ এবং মহিষাসুর মর্দিনী কথিকা। দুর্গাপুজো যেন ঐদিন আরম্ভ হয়ে যেত। মাতলরে ভুবন...।

সেই চতুর্দশী ও অমাবস্যার সন্ধিক্ষণে, দিবাবসানের সময়, গোধূলী বেলায় আমাদের পিতামহ অন্নদাচরণের জীবনদীপ নিবার্পিত হয়। তখন আমি খুব ছোট, দশের মতো বয়স। আমরা সকলে ঘিরে বসেছিলাম পিতামহকে। তাঁর দশটি নাতি, দশটি নাতনি। সকলে ছিল না। কনিষ্ঠ পুত্র তখনো পূর্ব পাকিস্তানে। আমি দেখেছিলাম কীভাবে প্রাণবায়ু অনন্তে মিশে যায়। শ্বাস নিতে নিতে আর পারলেন না তিনি। তাঁকে রাত্রেই নিয়ে যাওয়া হয়েছিল ইছামতীর তীরে বসিরহাট শ্মশানে। ইছামতীর ওপারেই, ন’ দশ মাইল গেলে সাতক্ষীরা শহরের লাগোয়া আমাদের গ্রাম ধূলিহর। খুব কাছেই সেই দেশ, অন্যদেশ। বাবারা দাহ করে ফিরেছিলেন ভোরবেলা। তখন রেডিও থেকে বীরেন ভদ্র মশায়ের মেঘমন্দ্র কণ্ঠধ্বনি ছড়িয়ে পড়ছে ভোরের বাতাসে। পিতৃহারা দুই পুত্র এসে বসলেন বারান্দায়। অন্য পুত্রটি তখন অন্য দেশে, জানেও না মহাগুরু পতন হয়ে গেছে তার অজান্তে।

আজও মহালয়া এলে সেই মৃত্যুর কথা মনে পড়ে আমার। সেই ভোর। গুরুদশা, হাতে কঞ্চি ও কম্বলের আসন, দুই ভাই বসে আছে বারান্দায়। গ্রামের অনেক মানুষজন বসে আছে হেথাহোথা। মহালয়া এলে একটু মন খারাপ হয় সত্য। বাবা-কাকারা কেউ নেই এখন। তাঁদের তর্পণ করা হয় এইদিন। আমি ভোরে বিছানায় শুয়ে সেই গোধূলীবেলার কথা ভাবি। বাবার সঙ্গে আমি কয়েকবার গঙ্গায় গিয়েছি।  শেষে বাবা আর গঙ্গায় যেতেন না, বাড়িতে করতেন পিতৃপুরুষ স্মরণ। নিজে চণ্ডীপাঠ করতেন। বাবার প্রয়াণ হয়েছিল ভাদ্র সংক্রান্তির দিনে। তারপর আমরা তিন ভাই একসঙ্গে তর্পণ করেছি বেশ কয়েক বছর। হ্যাঁ, বাড়িতে। গঙ্গায় সেদিন বড় কলরব, হৈ হৈ। বাড়ি অনেক শান্ত। একবার মহালয়ার আগের দিনে আমি ছিলাম সিউড়িতে সাহিত্যের এক অনুষ্ঠানে। লেখক রমানাথ রায়, জয়ন্ত দে, অরিন্দম বসু ছিলেন। পরদিন ভোরে আমরা চললাম ময়ুরাক্ষী ব্যারেজে। ময়ুরাক্ষীতে পিতৃতর্পণ করব। ব্যারেজে যা হয়, একদিকে জল টলটল করছে, অন্যদিকে ধুধু বালুচর। কী অপরিসীম শূন্যতা! সেই ভোরে সেখানে মানুষজনও বিশেষ ছিল না। হয়তো নদীর অন্য কোথাও হয় তর্পণ। নিঃঝুম প্রকৃতিতে দাঁড়িয়ে অনুভব করেছিলাম প্রিয়জন না থাকার বেদনাটি। বাবার আগে তাঁর দুই ভাই চলে গিয়েছিলেন। সকলের কথা মনে পড়ছিল আমার। খা খা বালুচরে দাঁড়িয়ে তৃষ্ণার্ত পিতৃকুল, মাতৃকুল যেন জল চাইছিলেন। ধোঁয়া ধোঁয়া তাঁদের দেখতে পাচ্ছিলাম আমি। আমরা সকলেই ব্যারেজের জলের কাছে গিয়ে সেই জল হাতে ছুঁয়ে স্মরণ করেছিলাম পরলোকবাসী আত্মজনদের। প্রয়াত বান্ধব, অবান্ধবদের। চেনা অচেনাদের। আমাদের শাস্ত্র বলি, দর্শন বলি তা কবি-কল্পনায় পরিপূর্ণ। বিশ্বাস এই যে মহালয়ার দিনে প্রয়াত সকল মানুষের জীবাত্মা মর্ত্যে আসে তৃষিত হয়ে। তাদের জলদান করতে হয়। শুধু আত্মজন নন তাঁরা, অনাত্মীয়, অচেনা, অবান্ধব, সন্তানহীন আত্মারা আসেন জল গ্রহণ করতে। ময়ুরাক্ষী ব্যারেজের যেদিকে জল, সেইদিকে গভীরতা অনেক বেশি। বিপজ্জনকও। স্নান করা হয়নি। কিন্তু জল দিয়েছিলাম তাঁদের। তাঁরা তা নিয়েছিলেনও জানি। আমি ফিরে আসতে আসতে দেখেছিলাম ধুধু বালুচরে দাঁড়িয়ে আছেন, পিতা, পিতৃব্য, পিতামহ, পিতামহী, মাতামহ, মাতামহী, প্রপিতামহ...।

মহালয়ার পরদিন থেকে শুক্লপক্ষের শুরু। আমাদের উৎসব শুরু হয়ে যায় মহালয়ার ভোরে বীরেন্দ্রকৃষ্ণের কণ্ঠধ্বনিতে। বাণীকুমার প্রযোজিত আকাশবাণীর ওই অনুষ্ঠান পুজোর অঙ্গ হয়ে গেছে বুঝি এখন। ঐ কণ্ঠই যেন ঘোষণা করে শারদোৎসব সমাগত। কতকাল ধরে, সেই বাল্যকাল থেকে শুনছি, কিন্তু এখনো যেন নতুন হয়েই আসে তা বৎসরান্তে। সুপ্রীতি ঘোষের কণ্ঠে সেই গান: ‘বাজলো তোমার আলোর বেনু, মাতলোরে ভুবন’ ঘুম ভাঙিয়ে দেয়। তারপর বীরেন্দ্রকৃষ্ণের কণ্ঠে মহিষাসুর মর্দিনী। ঘুম আর তন্দ্রার ভিতরে কানে আসে সেই অমৃতবাণী। হ্যাঁ, আকাশবাণীর এখানে জিত। টেলিভিশন কিছুই করতে পারেনি মহিষাসুরমর্দিনী সাজিয়েগুজিয়ে দেখিয়ে। এখানে যে কল্পনা আছে, টেলিভিশনে তা নেই। মুক্তা ফলের মতো নীলাভ ঊষাকালে সেই কল্পনাকে আর কিছুই ছাপিয়ে যেতে পারে না।

মহালয়ার দিন থেকে আর মন থাকে না কাজে। আর তো কয়েকটা দিন। মহালয়ার আর এক স্মৃতি আছে, সেবার পিতামহের অসুখের চিকিৎসার জন্য বাবার হাত খালি। পুজোর জামা-প্যান্ট হয়নি। কাঁদছি। বাবা আমার মামিমার হাতে দশটি টাকা দিয়ে বললেন, শ্যামবাজারে গিয়ে কিনে দাও যা হয়। ফুটপাথের হকারের কাছ থেকে দশ টাকায় জামা, প্যান্ট, অলিম্পিক হাওয়াই...। আহা কী আনন্দ! সেই আনন্দ টিকিয়ে রেখেছি এখনো। মহালয়ার দিনে সেই সন্ধ্যার কথাও মনে পড়ে খুব। আনুষ্ঠানিক পিতৃ তর্পণ আর হয় না মহালয়ার সকালে। কিন্তু মনে পড়ে সব শেষ রাত্রে, ট্রানজিস্টার বাজলে।




রাইজিংবিডি/ঢাকা/৮ অক্টোবর ২০১৮/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়