ঢাকা     শুক্রবার   ২৬ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১৩ ১৪৩১

তারা নিজেদের উপস্থাপন করেন সরল মানুষ হিসেবে

আহমদ নূর || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৩:১৬, ২৯ জুলাই ২০১৭   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
তারা নিজেদের উপস্থাপন করেন সরল মানুষ হিসেবে

আহমদ নূর : রাসেল আহমেদ। সিলেট নগরীর ২৬ বছর বয়সী এ যুবক বছরখানেক আগে একদিন রিকশায় চড়ে বাসায় যাচ্ছিলেন। রিকশা থেকে নামার পর যখন ভাড়া দেবেন তখন চালক তাকে একটি নোট দেখালেন। নোটটি ব্রিটিশ ২০ পাউন্ডের ছিল।

রিকশাচালক তাকে জানালেন, এটি তিনি ভাঙাচ্ছেন না। কারণ, বিদেশী মুদ্রা, তাকে ঠকাতে পারে।

রাসেল আহমেদকে ভাল মানুষ ও সরল মানুষ হিসেবে অভিহিত করে রিকশাচালক নোটটি ভাঙিয়ে দিতে বললেন এবং জানালেন তার কাছে এমন আরো নোট আছে যার পরিমাণ মোট তিন হাজার পাউন্ড।

রাসেল রিকশাচালককে জিজ্ঞেস করলেন, এই নোট তিনি কীভাবে কোথায় পেলেন।

রিকশাচালক জবাবে বললেন, এক প্রবাসী তার রিকশায় উঠেছিলেন। প্রবাসী নেমে চলে যাওয়ার পর তিনি রিকশার সিটে মানিব্যাগ পান। ওই মানিব্যাগে এই নোটগুলো ছিলো। সেই প্রবাসীকে তিনি অনেক খুঁজেছেন কিন্তু পাননি এবং সে কারণে মানিব্যাগটি নোটসহ ফেরত দিতে পারেননি। এখন এগুলো ফেলে রেখে কি হবে, তাই ভাঙানোর কথা ভাবছেন।

অল্প সময়েই বেশ মোটা দাগে অর্থ কামানো যেতে পারে- এই চিন্তা করে রাসেল ওই রিকশাচালককে প্রস্তাব দেন, তিনি যেন বিদেশী মুদ্রাগুলো তাকেই দেন। রাসেল রিকশাচলককে বোঝান যে, তিনি (রিকশাচালক) এগুলো ভাঙাতে গেলে সবাই সন্দেহ করবে। যেহেতু নোটগুলো বৈধ নয়, তাই মুদ্রা বিনিময়ের নির্ধারিত হারের চেয়ে তিনি কিছু টাকা কম দেয়ার কথা বলেন।

রাসেলের এ প্রস্তাবে রাজি হয়ে যান রিকশাচালক। তবে এর আগে নোট আসল না নকল তা পরীক্ষার জন্য সময় চান রাসেল আহমেদ। এতেও রাজি হন রিকশাচালক। কথা হয়, নোট আসল হলে পরের দিন সবগুলো নোট রাসেলকে দেবেন রিকশাচালক। তবে শর্ত থাকে যে, সবগুলো নোট ভাঙালে যে পরিমাণ বাংলাদেশী টাকা হবে তা রিকশাচালককে একসঙ্গে দিতে হবে এবং রিকশাচলক যে জায়গায় যাওয়ার কথা বলবেন সেখানে গিয়ে লেনদেন করতে হবে। যোগাযোগ করার জন্য রাসেলকে একটি মোবাইল ফোন নাম্বার দিয়ে যান ওই রিকশাচালক।

সন্ধ্যায় ২০ পাউন্ডের নোটটি ভাঙাতে গিয়ে রাসেল দেখেন সেটি আসল। ফোনে যোগাযোগ করে পরের দিন তিন হাজার পাউন্ড নেওয়ার জন্য দুই লাখ টাকা নিয়ে রিকশাচালকের বলে দেওয়া নির্ধারিত জায়গায় যান। জায়গাটি ছিল জানাকীর্ণ। সেই জায়গায় রিকশাচালক একটি পলিথিনের ব্যাগ দিয়ে বলেন, এতে সবগুলো নোট আছে। বিশ্বাস করে দুই লাখ টাকা দিয়ে সেই ব্যাগ নিয়ে বাসায় চলে আসেন রাসেল।

বাসায় আসার পর রাসেল ব্যাগ খুলে দেখেন, ব্যাগের ভেতরে দুটি নোট আছে। বাকিগুলো সাদা কাগজ। সঙ্গে সঙ্গে ওই রিকশাচালককে ফোন দেন। কিন্তু সেটি বন্ধ পান। বুঝতে পারেন তিনি প্রতারণার ফাঁদে পড়েছেন। কম সময়ে বেশি টাকা কামাইয়ের লোভ করে প্রতারিত হয়েছেন। তিনি প্রতারিত হওয়ার কথা কাউকে জানাতে লজ্জা পাচ্ছিলেন। এমনকি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকেও বিষয়টি জানাননি।

প্রায় একই রকম একটি প্রতারণার ফাঁদে পড়তে যাচ্ছিলেন মৌলভীবাজার জেলার কুলাউড়ার জুয়েল আহমেদ। এক ফেরিওয়ালার কাছ থেকে আমেরিকান মুদ্রা (ইউএস ডলার) কিনতে যাচ্ছিলেন। তবে কেনার আগে তিনি তার বন্ধুর সঙ্গে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করেন। তার বন্ধু বুঝতে পারেন জুয়েল প্রতারকের ফাঁদে পড়েছেন। এরপর তিনি ওই ডলার আর কেনেননি।   

দেশের বিভিন্ন স্থানে এ ধরণের প্রতারণার অভিযোগ প্রায়ই শোনা যায়। এভাবে প্রতারণার সাথে জড়িত আছে কয়েকটি চক্র। চক্রের সদস্যরা নিজেদেরকে সহজ-সরলভাবে মানুষের কাছে উপস্থাপন করেন। নিজের কাছে বিদেশী মুদ্রা বা স্বর্ণের বার আছে বলে গল্প করেন বা দেখান। অনেকে এগুলো কিনতে আগ্রহী হয়ে ওঠেন। এতে ওই ব্যক্তিকে বোকা বানিয়ে জাল নোট, সাদা কাগজ বা স্বর্ণ বলে সোনালী রঙের পদার্থ দিয়ে পালিয়ে যান। তারা তাদের সঙ্গে যোগাযোগের জন্য যে ফোন নম্বর দেন সেটিও বন্ধ করে দেন। ফলে তাদের খুঁজে পাওয়া যায় না। অনেকে প্রতারিত হওয়ার পর লোকলজ্জার ভয়ে, হয়রানির ভয়ে পুলিশের কাছে যান না।

গত ২৭ জুলাই বৃহস্পতিবার মিরপুর মডেল থানা এলাকার ৬ নম্বর সেকশনের বি ব্লকে কাঁচাবাজারের দক্ষিণ পাশের বটতলা থেকে মো. কিবরিয়া শেখ (২৮), মো. বকুল শেখ (৫৫) ও সুব্রত দাস (২৪) নামের তিন জনকে গ্রেপ্তার করে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা (উত্তর) বিভাগ। তাদের কাছ থেকে ৫০ রিয়ালের পাঁচটি নোট উদ্ধার করা হয়। পুলিশ জানায়, তারা প্রতারক চক্রের সদস্য।  

একটি সূত্র জানায়, মো. মজিবুর রহমান নামের এক ব্যক্তি গত ২৪ নভেম্বর কচুক্ষেত থেকে রিকশায় বাসায় যাচ্ছিলেন। পথে রিকশাচালক সুব্রত দাস জানান, তার কাছে বিদেশী মুদ্রা আছে। মজিবুর রহমান রিকশা থেকে নামার পর রিকশাচালক তাকে নোটটি দেখিয়ে জানতে চান সেটা কোন দেশের, ভাঙালে কত পাবেন। ওই নোট দেখে তিনি সৌদি রিয়াল বলে জানান।

রিকশাচালক সুব্রত দাস নোট ভাঙিয়ে দেওয়ার জন্য মজিবুর রহমানকে অনুরোধ করেন। এতে সাড়া দিয়ে মজিবুর রহমান নোটটি ভাঙিয়ে দেয়ার ব্যবস্থা করেন। সুব্রত দাস কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে মজিবুরকে জানান যে, তার কাছে এমন আরো ১৩ বান্ডিল নোট আছে এবং সেগুলো ভাঙিয়ে দেওয়ার জন্য অনুরোধ করেন। পারিবারিক সংকটের কথা বলে সুব্রত আগাম কিছু টাকাও চান।

বিষয়টিতে সন্দেহ হলে মজিবুর এ ঘটনা গোয়েন্দা পুলিশকে অবহিত করেন। এরপর গোয়েন্দা পুলিশের জ্যেষ্ঠ সহকারী কমিশনার (এসি) নিশাত রহমান মিথুনের নেতৃত্বে পুলিশের এক অভিযানে তাদেরকে গ্রেপ্তার করা হয়।

এ বিষয়ে নিশাত রহমান বলেন, ‘ঘটনা জানার পর তাৎক্ষণিকভাবে অভিযান পরিচালনা করে প্রতারক চক্রের তিনজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তারা নিজেদের সরল সোজা লোক হিসেবে উপস্থাপন করে মানুষের সঙ্গে প্রতারণা করে আসছিলো।’




রাইজিংবিডি/ঢাকা/২৯ জুলাই ২০১৭/নূর/শাহনেওয়াজ

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়