ঢাকা     মঙ্গলবার   ১৬ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৩ ১৪৩১

কামানের গোলায় নিহত ১৩

সাক্ষী না আসায় ঝুলে আছে বিচার

মামুন খান || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০২:২৪, ১৫ আগস্ট ২০১৭   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
সাক্ষী না আসায় ঝুলে আছে বিচার

মামুন খান : জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যার দিন ১৫ আগস্ট সকালে খুনিদের ছোড়া কামানের গোলায় মোহাম্মদপুরের শেরশাহ সুরী রোডে ১৩ জন নিহত হন। ওই ঘটনায় ১৯৯৬ সালে ২৯ নভেম্বর মোহাম্মাদপুর থানায় দায়ের হওয়া মামলার বিচার গত ২০ বছরেও শেষ হয়নি।

ওই ঘটনায় দায়ের করা মামলায় আসামিদের বিরুদ্ধে প্রায় ১১ বছর আগে অভিযোগ গঠন হলেও এখন পর্যন্ত এর বিচার কাজ শেষ হয়নি। আদালতে সাক্ষী না আসায় এ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। ঢাকার চতুর্থ অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ আদালতে মামলাটি এখন সাক্ষ্য গ্রহণের পর্যায়ে ঘুরপাক খাচ্ছে। সর্বশেষ গত তারিখে সাক্ষী না আসায় আগামি ১২ সেপ্টেম্বর সাক্ষ্য গ্রহণের পরবর্তী তারিখ ঠিক করেছেন ওই আদালতের বিচারক মো. জাহিদুল কবির।

এদিকে এখনও পর্যন্ত কোনো প্রকার সহায়তা পায়নি নিহত হতদরিদ্র পরিবারগুলো। মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষের শক্তি ক্ষমতায় থাকায় সরকারের কাছে তারা (হতাহত পরিবার) ওই হত্যাকা-ের দ্রুত বিচারের পাশাপাশি পুনর্বাসনের দাবি জানিয়েছে।

মামলার বাদী মুক্তিযোদ্ধা মোহাম্মদ আলী বলেন, আমি তখন ২৪ বছরের যুবক। মোহাম্মদপুরের শেরশাহ সুরী রোডের ৮ নম্বর বাড়িটি ছিল আমার। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানকে হত্যার দিন ভোর সাড়ে ৫টায় বাসার ওপর কামানের গোলা এসে পড়ে। সেখানে বাসার ভাড়াটিয়া ও আমার গ্রামের লোকজন অবস্থান করছিল। কামানের গোলায় আমার দূরের সম্পর্কের আত্মীয় রিজিয়া বেগমসহ ১৩ জন সেখানে মারা যান। প্রায় ৪০ জন আহত হন। আহতদের তাৎক্ষণিক হাসপাতালে চিকিৎসা দেওয়া হয়। ওই ঘটনায় মামলা করতে গেলে তৎকালীন মোহাম্মদপুর থানার ওসি রব দেশের অস্থিতিশীল পরিস্থিতির অযুহাতে মামলা না নিয়ে আমাকে ফিরিয়ে দেন। আর কামানের গোলায় নিহত লাশগুলোকে কবর দিয়ে দিতে বলেন।

তিনি বলেন, ‘একপর্যায়ে ১৫ আগস্ট যা কিছু হয়েছে এ ব্যাপারে কোনো মামলা করা যাবে নাÑ এ সংক্রান্ত আইন পাস হয়। ফলে চেষ্টা করেও ওই সময় আর মামলা করা সম্ভব হয়নি। পরে মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষের শক্তি ক্ষমতায় এলে ওই আইন বাতিল হয়। এরপর ১৯৯৬ সালে স্বশরীরে মোহাম্মদপুর থানায় গিয়ে কামানের গোলায় ১৩ জনকে হত্যার মামলা দায়ের করি।

দু:খ প্রকাশ করে তিনি বলেন, গুরুত্বপূর্ণ এ মামলা দীর্ঘ দিনেও শেষ না হওয়া অত্যন্ত দুঃখজনক। পলাতক আসামিদের দেশে ফিরিয়ে এনে তাদেরও শাস্তি নিশ্চিত করার দাবি জানান তিনি। দীর্ঘদিনেও (ঘটনার পর থেকে এখন পর্যন্ত) কেউ হতদরিদ্র ওই পরিবারগুলোর খবর নিতে আসেনি। কোনো প্রকার আর্থিক সহায়তাও করেনি। বর্তমানে হতদরিদ্র ওই পরিবারগুলোর পুনর্বাসনের জন্য মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সদয় দৃষ্টি আকর্ষণ করেন তিনি।

আদালত সূত্রে জানা গেছে, ২০০৭ সালে ১৯ মার্চ এ মামলায় বাদীর প্রথম সাক্ষ্য গ্রহণ হয়। এরপর দীর্ঘদিন বাদীর পূর্ণাঙ্গ সাক্ষ্য গ্রহণ হয়নি। সর্বশেষ ২০১৫ সালের ৭ মে আদালতে এ মামলায় বাদী অবশিষ্ট সাক্ষ্য দেন। আর বাদীর ওই পূর্ণাঙ্গ সাক্ষীর পর থেকে এখন পর্যন্ত আর কোনো সাক্ষী আদালতে হাজির করতে পারেনি পুলিশ। মামলাটিতে এখন পর্যন্ত বাদীসহ ১৫ জনের সাক্ষ্য গ্রহণ শেষ হয়েছে। তবে মামলার দুই তদন্ত কর্মকর্তাসহ ৪৩ জনের সাক্ষ্য গ্রহণ এখনও হয়নি।

জানতে চাইলে ঢাকার চার নম্বর অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ আদালতের কৌসুলি সাইফুল ইসলাম হেলাল বলেন, ‘মামলায় সাক্ষ্য গ্রহণের জন্য রাষ্ট্রপক্ষ সর্বাত্মক প্রচেষ্টা অব্যাহত রেখেছে। সাক্ষীদের হাজির করার জন্য স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়সহ সংশ্লিষ্ট সকল স্থানে দফায় দফায় চিঠি দেওয়া হয়েছে। বার বার সমন পাঠানোর পরও মামলার গুরুত্বপূর্ণ সাক্ষী দুই তদন্তকারী কর্মকর্তা এখনও সাক্ষ্য দিতে আদালতে আসেননি। অন্যান্য সাক্ষীদের প্রতিও যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ করেছেন আদালত। কিন্তু কিছুতেই পুলিশ সাক্ষীদের আদালতে হাজির করতে পারছে না।

পলাতক আসামিদের পক্ষে রাষ্ট্র নিয়োজিত স্টেট ডিফেন্স আইনজীবী মোহাম্মদ মাহফুজুর রহমান চৌধুরী পুলিশ বিভাগকে দায়ী করে বলেন, সাক্ষী হাজির করার দায়িত্ব পুলিশের। আমরা আদালত থেকে যথাযথভাবে সাক্ষী হাজির করতে পুলিশের কাছে সমন/ওয়ারেন্ট পাঠানোর পরও পুলিশ সাক্ষী হাজির করছে না।

তিনি বলেন, ‘প্রধান বিচারপতি ও আইনমন্ত্রণালয় থেকে বার বার পুরাতন মামলাগুলোর জট কমানোর তাগিদ দেওয়া হচ্ছে। আদালত ও প্রসিকিউশন একাধিকবার সাক্ষী হাজির করতে বিভিন্ন পদক্ষেপ নিলেও সাক্ষী না আসায় মামলা নিষ্পত্তিতে গতি আসছে না। দীর্ঘদিনের পুরাতন এই মামলার বিচার কাজ যত দ্রুত সম্ভব শেষ হওয়া উচিত।

আদালত সূত্র বলছে, একাধিকবার সমন পাঠানোর পরও আদালতে সাক্ষী দিতে হাজির না হওয়ায় ১০ সাক্ষীর বিরুদ্ধে ইতোমধ্যেই গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেছেন আদালত। এদের মধ্যে একজন সাক্ষীকে ঠিকানা অনুসারে পাওয়া যায়নি বলে পুলিশী প্রতিবেদন আদালতে এসেছে। বাকি নয় জনের ক্ষেত্রে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা তামিল সংক্রান্ত প্রতিবেদনই এখন পর্যন্ত আদালতে দাখিল করেনি পুলিশ।

সাক্ষী না দেওয়ায় যাদের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করা হয়েছে তারা হলেনÑ মামলার ১৪ নম্বর সাক্ষী মো. মজিবুর রহমান, ১৫ নম্বর সাক্ষী বিনু বিবি, ২৩ নম্বর সাক্ষী মাহতাব আলী খান, ২৫ নম্বর সাক্ষী মো. সামছুল হক, ৩০ নম্বর সাক্ষী আবুল কালাম, ৩৬ নম্বর সাক্ষী আব্দুর রব, ৩৭ নম্বর সাক্ষী আয়েশা খাতুন, ৩৮ নম্বর সাক্ষী আব্দুল মালেক, ৩৯ নম্বর সাক্ষী মনোয়ার বেগম ও ৪৯ নম্বর সাক্ষী মো. আজাদ রহমান। এদের মধ্যে মাহতাব আলী খান ঠিকানা অনুসারে নেই বলে আদালতে প্রতিবেদন দিয়ে জানিয়েছে পুলিশ। অন্যদের কোনো তথ্য আদালতে দেয়নি পুলিশ।

প্রসঙ্গত, ৪২ বছর আগের ওই হত্যার ঘটনায় মামলা হয় ১৯৯৬ সালে। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ভোর সাড়ে ৫টার দিকে ধানমন্ডির ৩২ নম্বরে বঙ্গবন্ধুর বাড়ি আক্রমণের সময় সেনা সদস্যরা কামানের গোলা ছুঁড়লে তা গিয়ে মোহাম্মদপুরের শেরশাহ সুরী রোডর ৮ ও ৯ এবং ১৯৬ ও ১৯৭ নম্বর বাড়ির (টিনশেড বস্তি) ওপর পড়ে। লে. কর্নেল মুহিউদ্দিন আহমেদের (আর্টিলারি) ছোড়া কামানের গোলার বিকট শব্দে প্রকম্পিত হয়ে ওঠে গোটা এলাকা। মুহূর্তে ধুলায় মিশে যায় ওই বস্তি। ওই ঘটনায় নারী ও শিশুসহ ১৩ জন মারা যায়। প্রায় ৪০ জন আহতের মধ্যে কয়েকজন পুরুষ সারাজীবনের জন্য পঙ্গুত্ব বরণ করে। নিহতরা হলো রিজিয়া বেগম ও তার ছয় মাসের মেয়ে নাসিমা, কাশেদা বেগম, ছাবেরা বেগম, সাফিয়া খাতুন, আনোয়ারা বেগম (প্রথম), ময়ফুল বিবি, আনোয়ারা বেগম (দ্বিতীয়), হাবিবুর রহমান, আবদুল্লাহ, রফিজল, সাহাব উদ্দিন আহম্মেদ ও আমিন উদ্দিন আহম্মেদ।

ওই ঘটনায় ৮ নম্বর বাড়ির মালিক মোহাম্মদ আলী বাদি হয়ে ১৯৯৬ সালের ২৯ নভেম্বর মোহাম্মদপুর থানায় এ মামলা দায়ের করেন। ২০০১ সালের এপ্রিলে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি) আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করে। এরপর ২০০৬ সালের ১ নভেম্বর এ মামলায় ১৭ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করেন আদালত।

১৭ আসামির মধ্যে ২০১০ সালের ২৮ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলায় মৃত্যুদ-প্রাপ্ত পাঁচ জনের ফাঁসি কার্যকর করা হয়। এরা হলেন লেফটেন্যান্ট কর্নেল (অব.) সৈয়দ ফারুক রহমান, লেফটেন্যান্ট কর্নেল (অব্যাহতিপ্রাপ্ত) সুলতান শাহরিয়ার রশিদ, লেফটেন্যান্ট কর্নেল (অব.) মুহিউদ্দিন আহমেদ, মেজর (অব.) বজলুল হুদা ও মেজর (অব্যাহতিপ্রাপ্ত) একেএম মহিউদ্দিন আহমেদ। ওই পাঁচজন ছাড়া এ মামলায় প্রাক্তন অর্থমন্ত্রী তাহের উদ্দিন ঠাকুরকে (প্রয়াত) গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছিল। এছাড়া মামলার অপর ১১ আসমি পলাতক রয়েছেন।

পলাতকরা হলেন লেফটেন্যান্ট কর্নেল (অব্যাহতিপ্রাপ্ত) শরিফুল হক ডালিম, লেফটেন্যান্ট কর্নেল (বরখাস্ত) খন্দকার আবদুর রশিদ, লেফটেন্যান্ট কর্নেল (অবসরপ্রাপ্ত) এসএইচএমবি নূর চৌধুরী ইবি, ক্যাপ্টেন (অব.) আবদুল মাজেদ, লেফটেন্যান্ট কর্নেল (অব.) এএম রাশেদ চৌধুরী, লেফটেন্যান্ট কর্নেল (অব্যাহতিপ্রাপ্ত) আহমদ শরিফুল হোসেন ওরফে শরিফুল ইসলাম, ক্যাপ্টেন (অব্যাহতিপ্রাপ্ত) মো. কিসমত হাসেম, ক্যাপ্টেন (অব.) নাজমুল হোসেন আনসার, রিসালদার (অবসরপ্রাপ্ত) মোসলেম উদ্দিন ওরফে মোসলেহ উদ্দিন, দফাদার মারফত আলী ও এলভি মো. আলী হোসেন মৃধা।

 

 

 


রাইজিংবিডি/ঢাকা/১৫ আগস্ট ২০১৭/মামুন খান/শাহনেওয়াজ

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়