ঢাকা     বুধবার   ২৪ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১১ ১৪৩১

‘রিশা হত্যা : ঝুলে গেছে বিচারকাজ’

মামুন খান || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৭:০৯, ২৮ আগস্ট ২০১৭   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
‘রিশা হত্যা : ঝুলে গেছে বিচারকাজ’

মামুন খান : রাজধানীর কাকরাইলে উইলস লিটল ফ্লাওয়ার স্কুলের ছাত্রী সুরাইয়া আক্তার রিশা হত্যার বিচার এক বছরেও হয়নি। চাঞ্চল্যকর এ হত্যা মামলার বিচারকাজ ঝুলে গেছে বলে বাদীপক্ষ উল্লেখ করেছেন এবং মামলায় নিজেদের আগ্রহ হারিয়ে ফেলার কথা বলেছেন।

গত বছর ২৪ আগস্ট দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে উইলস লিটল ফ্লাওয়ার স্কুলের সামনে ফুট ওভারব্রিজে রক্তাক্ত অবস্থায় রিশাকে পাওয়া যায়। স্কুলের শিক্ষার্থীরা তাকে উদ্ধার করে হাসপাতালে নিয়ে যায়। এরপর ২৮ আগস্ট সকালে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় রিশার মৃত্যু হয়।

রিশা হত্যাকা-ের দিনই তার মা তানিয়া হোসেন রাজধানীর রমনা থানায় নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের ১০ ধারায় এবং দ-বিধির ৩২৪/৩২৬/৩০৭ ধারায় হত্যাচেষ্টা ও গুরুতর আঘাতের অভিযোগে একটি মামলা করেন। রিশার মৃত্যুর পর হত্যার অভিযোগে ৩০২ ধারা সংযোজন করা হয়।

মামলাটি তদন্ত করে গত বছরের ১৪ নভেম্বর ওবায়দুল হককে একমাত্র আসামি করে অভিযোগপত্র দাখিল করেন মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা রমনা থানার পুলিশ পরিদর্শক আলী হোসেন। এরপর গত ১৭ এপ্রিল মামলার একমাত্র আসামি ওবায়দুল হকের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করে বিচার শুরুর আদেশ দেন আদালত। অভিযোগপত্রে ২৬ জন সাক্ষীর মধ্যে এ মামলায় আসামি দোষ স্বীকারোক্তি রেকর্ডকারী ম্যাজিস্ট্রেট ও ১ম তদন্ত কর্মকর্তাসহ ১৯ জন সাক্ষীর সাক্ষ্য গ্রহণ সম্পন্ন হয়েছে। মামলার সর্বশেষ তদন্ত কর্মকর্তার সাক্ষ্য গ্রহণের জন্য ইতোমধ্যেই আদালতের কয়েকটি ধার্য তারিখ পার হয়েছে। গতকাল রোববার (২৭ আগস্ট) শেষ তদন্তকারী কর্মকর্তার সাক্ষ্য গ্রহণের দিন ধার্য ছিল। এ কর্মকর্তার সাক্ষ্য গ্রহণ শেষ হলেই মামলায় প্রসিকিউশনের সাক্ষ্য গ্রহণ পর্ব শেষ করার কথা ছিল।

কিন্তু সম্প্রতি ‘সঠিক আদালতে বিচার না হওয়ায়’ মামলাটি ঢাকার শিশু আদালতে বদলি করা হয়েছে। ফলে সর্বশেষ তদন্তকারী কর্মকর্তার সাক্ষ্য গ্রহণ পর্যায়ে থাকা এ মামলাটিতে পুনরায় সাক্ষ্য গ্রহণ করতে হবে। এদিকে বিচারের শেষের দিকে এসে আদালত পরিবর্তনের খবর শুনে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়েছে রিশার পরিবার। বিচারের দীর্ঘসূত্রতার কারণে রিশা হত্যা মামলা আর চালাবেন না বলে তাদের সিদ্ধান্তের কথা জানিয়েছেন তারা।

মামলার বাদী ও রিশার মা তানিয়া হোসেন বলেন, ‘দেখতে দেখতে এক বছর হয়ে গেলো আমার মেয়েকে হারিয়েছি। বিচার হবে বলে এতোদিন আশায় বুক বেঁধে ছিলাম। এখন নতুন করে আদালত পরিবর্তন হলে কত দিনে বিচার পাব কে জানে? মামলাটির বিচার শেষ করার ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণ করেন তিনি।

রিশার বাবা রমজান হোসেন বলেন, ‘প্রতিবার কোর্টে যাই, আট-দশ হাজার টাকা করে খরচ হয়। এতোদিন ধরে মামলা চালাচ্ছি, আর এখন আদালত পরিবর্তন হয়েছে। সংবাদ সম্মেলন করে দেশবাসীকে জানিয়ে দেবো, আমরা আর এ মামলা চালাব না।’

আসামিপক্ষের আইনজীবী ফারুক আহম্মেদ বলেন, ‘রিশা হত্যা মামলা এতোদিন ভুল আদালতে বিচার হয়েছে। মামলা শিশু আদালতে বদলি করার জন্য ঢাকার অষ্টম অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ আদালতে আবেদন করা হয়। আবেদন ওই আদালত নামঞ্জুর করায় সংশ্লিষ্ট আইনের ধারা উল্লেখ করে ঢাকা মহানগর দায়রা জজ আদালতে ‘ট্রান্সফার মিস কেস’ দায়ের করি। এ মামলায় চারজন শিশু সাক্ষী রয়েছে। আবেদনে ‘শিশু আইন অনুসারে সাক্ষী যদি শিশু হয় তাহলে ১৭ ধারার বিধান মোতাবেক একমাত্র বিচারের জায়গা হল শিশু আদালত’ উল্লেখ করা হয়। ঢাকা মহানগর দায়রা জজ আদালত পরিবর্তনের আবেদন মঞ্জুর করে মামলা ঢাকার শিশু আদালতে বদলির আদেশ দেন।’ বিদ্যমান আইনে শিশু আদালতে বিচারের ক্ষেত্রে মামলাটিতে এখন পর্যন্ত যাদের সাক্ষ্য নেওয়া হয়েছে তাদের সাক্ষ্য ফের গ্রহণ করতে হবে বলে জানান তিনি।

বাদীপক্ষে আইনি সহায়তাকারী বাংলাদেশ জাতীয় মহিলা আইনজীবী সমিতির সদস্য ফাহমিদা আক্তার রিংকি বলেন, ‘এক বছরের মধ্যেই এ মামলার বিচার কাজ শেষ হবে বলে আমরা আশা করেছিলাম। কিন্তু আদালত পরিবর্তন হওয়ায় ফের চার্জগঠন-সাক্ষ্য সবই পুনরায় করতে হবে।’ এ বিষয়ে প্রচ- হতাশা প্রকাশ করেন তিনি।

এদিকে সাক্ষ্য গ্রহণের শেষ পর্যায়ে এসে গত ৩১ জুলাই আসামিপক্ষ ঢাকার অষ্টম অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ আবুল কাশেমের আদালতে তিনটি দরখাস্ত দাখিল করে। দরখাস্তের বিষয়কে অযৌক্তিক হিসেবে উল্লেখ করে আদালত এটিকে ‘মামলা বিলম্বিত করার প্রয়াস’ বলে মন্তব্য করেন।

প্রথম দরখাস্তে আসামির বিরুদ্ধে পেনাল কোড ৩০২ ধারায় অভিযোগ গঠনের কোনো উপাদান নেই বলা হয়। এ পরিপ্রেক্ষিতে মামলার এজাহার, অভিযোগপত্র, গৃহীত ১৯ জনের সাক্ষ্য পর্যালোচনা করে অভিযোগপত্র পরিবর্তনের এ দরখাস্ত নামঞ্জুর করেন আদালত।

দ্বিতীয় দরখাস্তে বলা হয়, আসামি ও ভিকটিমের (রিশা) মধ্যে কথোপকথন ও ম্যাসেজ আদান-প্রদান হতো। এ অবস্থায় আসামি ও ভিকটিমের মোবাইল ফোন নম্বর দুটির কললিস্ট তলব প্রয়োজন। এ পরিপ্রেক্ষিতে আদালত বলেন, ‘মামলাটি একটি চাঞ্চল্যকর হত্যা মামলা। আসামি ফৌজদারি কার্যবিধির ১৬৪ ধারায় দোষ স্বীকার করেছে। দোষ স্বীকারোক্তি রেকর্ডকারী ম্যাজিস্ট্রেটসহ ১৯ জন সাক্ষীর সাক্ষ্য গ্রহণ করা হয়েছে।

প্রসিকিউশন পক্ষ উল্লেখ করে যে, এ মামলায় শেষ তদন্তকারী কর্মকর্তার সাক্ষ্য গ্রহণ করা হলে প্রসিকিউশনের পক্ষ থেকে সাক্ষ্য শেষ হবে। আসামি ভিকটিমকে হত্যা করেছে কি-না এটি মামলার মূল আলোচ্য বিষয়। ইতিমধ্যে গৃহীত ১৯ জন সাক্ষীর জেরায় আসামিপক্ষ আসামি ও ভিকটিমের মধ্যে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল এবং তারা দুজনে মোবাইল ফোনে আলাপ করতেন বলে কোনো সাজেশন দেননি। ফলে ‘মামলাটি বিলম্বিত হওয়ার প্রয়াস হিসাবে’ দরখাস্তটি করা হয়েছে বলে আদালত মনে করেন। এছাড়া তদন্তকারী কর্মকর্তা একটি কললিস্ট যাচাই করেছেন। দরখাস্তে উল্লেখিত ফোন নম্বর দুটির কললিস্ট যাচাই প্রয়োজন মনে করলে তদন্তকারী কর্মকর্তা ওই কললিস্ট যাচাই করতেন। ফলে দ্বিতীয় দরখাস্তটিও নামঞ্জুর করেন আদালত।

তৃতীয় দরখাস্তে মামলায় অভিযোগপত্রের ১১, ১১, ১৫ ও ১৬ নম্বর সাক্ষী শিশু হওয়ায় মামলাটি শিশু আদালতে বদলির জন্য বলা হয়। প্রসিকিউশন পক্ষ ওই দরখাস্তের বিরোধীতা করে উল্লেখ করেন, যেসব মামলায় সাক্ষী শিশু এবং আসামি প্রাপ্তবয়ষ্ক সেসব মামলা শিশু আদালতে বদলির প্রয়োজন নেই।

এমতাবস্থায় আদালত আদেশে বলেন, ‘ওই চারজন শিশু সাক্ষীর মধ্যে ইতোমধ্যেই দুই জনের সাক্ষ্য গ্রহণ হয়েছে। বাকী দুজনের সাক্ষ্য গ্রহণ প্রয়োজন নেই বলে প্রসিকিউশন উল্লেখ করেন। যেহেতু মামলাটি একটি চাঞ্চল্যকর হত্যা মামলা। সে প্রেক্ষিতে আদালত মামলাটি দ্রুত নিষ্পত্তির পদক্ষেপ গ্রহণ করেছেন। ইতোমধ্যেই একজন সাক্ষী ছাড়া বাকিদের সাক্ষ্য গ্রহণ হয়ে গেছে। আসামি প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ায় মামলাটি শিশু আদালতে বদলির প্রয়োজন নেই। ফলে তৃতীয় দরখাস্তও নামঞ্জুর করা হয়েছে।

এরপর সম্প্রতি আসামিপক্ষ তৃতীয় দরখাস্তের বিষয়টি উল্লেখ করে ঢাকা মহানগর দায়রা জজ আদালতে মামলাটি বদলির আবেদন করে।

শুনানি শেষে এতোদিন সঠিক আদালতে বিচার না হওয়ায় ঢাকা মহানগর দায়রা জজ আদালত মামলাটি শিশু আদালতে বদলির আদেশ দেন।

প্রসঙ্গত, গত বছরের ২৪ আগস্ট দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে কাকরাইলে উইলস লিটল ফ্লাওয়ার স্কুলের সামনের ফুট ওভারব্রিজে রক্তাক্ত অবস্থায় রিশাকে পাওয়া যায়। স্কুলের শিক্ষার্থীরা তাকে উদ্ধার করে হাসপাতালে নিয়ে যায়। এরপর ২৮ আগস্ট সকালে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় রিশার মৃত্যু হয়।

ঘটনার দিনই রিশার মা তানিয়া রাজধানীর রমনা থানায় নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের ১০ ধারায় এবং দ-বিধির ৩২৪/৩২৬/৩০৭ ধারায় হত্যাচেষ্টা ও গুরুতর আঘাতের অভিযোগে একটি মামলা করেন। রিশা নিহত হওয়ার পর হত্যার অভিযোগে ৩০২ ধারা সংযোজন করা হয়।

ঘটনার পর থেকে ওবায়দুল পলাতক ছিলেন। রিশার মৃত্যুতে ঘাতক ওবায়দুলকে গ্রেপ্তার ও বিচারের আন্দোলন শুরু করে শিক্ষার্থীরা। তাকে ৩১ আগস্ট নীলফামারীর ডেমরা থানার সোনারগাঁও থেকে গ্রেপ্তার করা হয়। পরদিন ওবায়দুলের ৬ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন আদালত। রিমান্ড চলাকালীন চতুর্থ দিন ৫ সেপ্টেম্বর ওবায়দুল আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন। প্রেমের প্রস্তাবে রিশা রাজি না হওয়ায় তাকে খুন করেন বলে ওবায়দুল স্বীকারোক্তিতে উল্লেখ করেন। এরপর থেকে তিনি কারাগারেই রয়েছেন।

এদিকে মামলা তদন্ত করে গত বছরের ১৪ নভেম্বর ওবায়দুল হককে একমাত্র আসামি করে অভিযোগপত্র দাখিল করেন মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা রমনা থানার পুলিশ পরিদর্শক আলী হোসেন। অভিযোগপত্রে ২৬ জনকে সাক্ষি করা হয়।

নিহত রিশা রাজধানীর বংশাল থানাধীন সিদ্দিক বাজার এলাকার রমজান হোসেনের মেয়ে। অন্যদিকে ওবায়দুল দিনাজপুর জেলার বীরগঞ্জ উপজেলার মোহনপুর ইউনিয়নের মীরাটঙ্গী গ্রামের মৃত আবদুস সামাদের ছেলে। সে রাজধানীর ইস্টার্ন মল্লিকা শপিং মলের বৈশাখী টেইলার্সের কর্মচারী।

মামলার অভিযোগ থেকে জানা যায়, ৫/৬ মাস আগে রিশা ও তার মা তানিয়া ইস্টার্ন মল্লিকা মার্কেটে বৈশাখী টেইলার্সে কাপড় সেলাই করাতে যান। এ সময় তার মা ওই দোকানের রসিদের রিসিভ কপিতে ফোন নম্বর দিয়ে আসেন। টেইলার্সের কর্মচারী ওবায়দুল রিসিভ কপি থেকে ফোন নম্বর নিয়ে রিশাকে প্রেমের প্রস্তাব দিয়ে বিরক্ত করত।




রাইজিংবিডি/ঢাকা/২৮ আগস্ট ২০১৭/মামুন খান/শাহনেওয়াজ

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়