ঢাকা     বৃহস্পতিবার   ২৫ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১২ ১৪৩১

অসহায়-অসচ্ছল মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য হচ্ছে ‘মুক্তিযোদ্ধা পল্লী’

হাসান মাহামুদ || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১২:২২, ২৪ ডিসেম্বর ২০১৭   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
অসহায়-অসচ্ছল মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য হচ্ছে ‘মুক্তিযোদ্ধা পল্লী’

চিড়িয়াখানা রোড়ে মুক্তিযোদ্ধা কমপ্লেক্স এলাকায় মুক্তিযোদ্ধাদের একমাত্র বিশেষায়িত হাসপাতালের বর্তমান চিত্র

হাসান মাহামুদ : একাত্তরে জীবনবাজি রেখে যুদ্ধ করা বীর মুক্তিযোদ্ধাদের কল্যাণে গত কয়েক বছরে সরকার হাতে নিয়েছে বেশকিছু উদ্যোগ ও প্রকল্প। এরই অংশ হিসেবে এবার অসহায় ও অসচ্ছল মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য ‘মুক্তিযোদ্ধা পল্লী’ নির্মাণ করতে যাচ্ছে সরকার।

ঢাকার মিরপুর চিড়িয়াখানা রোডে যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা কমপ্লেক্স এলাকার জমির ওপর নির্মিত হবে এই পল্লী। এজন্য হাতে নেওয়া হয়েছে একটি প্রকল্প।

মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, এরই মধ্যে এ সংক্রান্ত প্রকল্পের প্রস্তাবনা (ডিপিপি) তৈরি প্রায় শেষ পর্যায়ে। ডিপিপি তৈরির পর এটি পর্যালোচনার জন্য পরিকল্পনা কমিশনে পাঠানো হবে।

খসড়া ডিপিপি থেকে জানা যায়, মিরপুরে চিড়িয়াখানার কাছে এই মুক্তিযোদ্ধা পল্লী নির্মাণ করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।

মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য প্রকল্পের আওতায় একটি বেজমেন্টসহ ২৩ তলাবিশিষ্ট ১৪টি অ্যাপার্টমেন্ট ভবন নির্মাণের পরিকল্পনা করা হয়েছে। এসব ভবনের প্রতিটি ফ্ল্যাট হবে ১৩৩৮ বর্গফুটের। মোট ১৪টি অ্যাপার্টমেন্ট ভবনের প্রতিটিতে ১৭৬টি করে সর্বমোট ২ হাজার ৪৬৪টি অ্যাপার্টমেন্ট নির্মাণের প্রস্তাব করা হয়েছে। এতে ব্যয় ধরা হয়েছে ১ হাজার ১০০ কোটি টাকা। আগামী ২০১৯ সালের জুনে মুক্তিযোদ্ধাদের ফ্ল্যাট বুঝিয়ে দেওয়ার পরিকল্পনা করেছে সরকার।

জানা গেছে, চলতি বছরের মধ্যেই প্রকল্পের কাজ শুরু করতে চেয়েছিল মন্ত্রণালয়। কিন্তু প্রকল্পটি এখনো অনুমোদন না পাওয়ায় কাজ শুরু করা যায়নি।

মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক বলেছেন, দেশের শ্রেষ্ঠ সন্তান বীর মুক্তিযোদ্ধাদের পুনর্বাসন এবং আর্থিক সচ্ছলতা আনার জন্য সরকার বেশকিছু প্রকল্প হাতে নিয়েছে। এর মধ্যে অসহায় ও অসচ্ছল মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য ‘মুক্তিযোদ্ধা পল্লী’ নির্মাণ করতে যাচ্ছে সরকার। যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা কমপ্লেক্স এলাকার জমির ওপর নির্মিত হবে এই পল্লী।

মন্ত্রী আরো বলেন, প্রকল্পটি বর্তমানে অনুমোদনের অপেক্ষায় রয়েছে। অনুমোদনের পর দ্রুত সময়ে এটি বাস্তবায়নের পরিকল্পনা রয়েছে আমাদের।

তিনি বলেন, মুক্তিযোদ্ধাদের আর্থ-সামাজিক কল্যাণে প্রায় পৌনে তিন হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে বিভিন্ন প্রকল্প হাতে নিয়েছে বর্তমান সরকার। এসব প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে মুক্তিযোদ্ধাদের আর অন্যের মুখাপেক্ষী হয়ে থাকতে হবে না এবং ভবিষ্যতে তাদের আর কেউ রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ব্যবহার করতে পারবে না।

মন্ত্রী বলেন, বর্তমান সরকার মুক্তিযোদ্ধাদের জীবনমান উন্নয়নে সম্মানীভাতা বৃদ্ধি, উন্নত চিকিৎসা প্রদান, সন্তানসহ তাদের পুত্র-কন্যাদের চাকরির নিশ্চিতকরণসহ ২৬টি কল্যাণমূলক কার্যক্রম নিশ্চিত করতে নিরলস প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।

এই প্রকল্পসহ আগামীতে হাতে নেওয়া অন্যান্য প্রকল্প সম্পর্কে মন্ত্রী বলেন, মুক্তিযোদ্ধাদের আর্থ-সামাজিক কল্যাণে বর্তমান সরকার যেসব প্রকল্প গ্রহণ করেছে এর মধ্যে, মুক্তিযুদ্ধকালে শহীদ মিত্রবাহিনীর সদস্যদের স্মরণে স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ, মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি স্থাপনাগুলো সংরক্ষণ, যুদ্ধে শহীদদের সমাধিস্থল সংরক্ষণ, সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে স্বাধীনতা স্তম্ভ নির্মাণ, মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি নিয়ে জাদুঘর নির্মাণ, নতুন প্রজন্মের কাছে মুক্তিযুদ্ধ জাগ্রতকরণ, বধ্যভূমি সংরক্ষণ, মুক্তিযোদ্ধা পল্লী এবং ভবন নির্মাণ ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য।

মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্ট সূত্র জানায়, ১৯৮০ সালের ২৫ মার্চ তত্কালীন রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান মিরপুরে ‘যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা কমপ্লেক্স’ ভবনের উদ্বোধন করেন। পরে জাতীয় পার্টি সরকারের আমলে মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসাসেবা প্রদানের লক্ষ্যে ফ্রান্সের আর্থিক সহায়তায় এখানে ১০০ শয্যার ট্রাস্ট আধুনিক হাসপাতালের নির্মাণকাজ শুরু হয়। পাশাপাশি শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের পরিবার এবং যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাদের পুনর্বাসন ও আবাসগৃহের জন্য মুক্তিযোদ্ধা কমপ্লেক্স ফান্ড কার্যকরভাবে পুনর্গঠন করা হয়।

১৯৯১ সালের ১ ডিসেম্বর তত্কালীন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য করা হাসপাতালের কার্যক্রম উদ্বোধন করেন। হাসপাতালটি চালুর পর মুক্তিযোদ্ধারা ছাড়াও সাধারণ মানুষ এখান থেকে কিছু চিকিৎসা সুবিধা পেত। একপর্যায়ে মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্ট প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে আলাদা হয়ে যাওয়ায় ওই হাসপাতালের কার্যক্রমে স্থবিরতা দেখা দেয়।

১৯৯৩ সালে মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্টের পক্ষ থেকে একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানকে হাসপাতালটি ইজারা দেওয়া হয়। ওই প্রতিষ্ঠান ‘ইসলামী উম্মাহ মেডিক্যাল কলেজ’ নাম দিয়ে হাসপাতালটি পরিচালনা শুরু করে। ২০০ ছাত্র-ছাত্রী ভর্তিও করে তারা। এ সময় মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য সরকারের নির্মিত এই হাসপাতালে মুক্তিযোদ্ধারাই চিকিৎসা সুবিধা থেকে বঞ্চিত হতে শুরু করেন; বরং এটিকে একটি বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানে রূপ দেওয়া হয়। এমন পরিস্থিতিতে ১৯৯৪ সালে বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্ট কেন্দ্রীয় সংগ্রাম পরিষদের আন্দোলনের মুখে সরকার ইজারা বাতিল করতে বাধ্য হয়।

১৯৯৬ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের বিজয়ের পরদিন বিদেশে চলে যান ইসলামী উম্মাহ করপোরেশনের চেয়ারম্যান মেজর (অব.) জয়নাল। ইসলামী উম্মাহ করপোরেশনের সদস্যরা হাসপাতালের নাম পরিবর্তনের চেষ্টা করেন। তবে ১৯৯৭ সালের মার্চে যথাযথ কর্তৃপক্ষের কাছে হাসপাতালটি বুঝিয়ে না দিয়েই ইসলামী উম্মাহ করপোরেশনের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা চলে যান। যাওয়ার সময় হাসপাতালের মূল্যবান যন্ত্রপাতি আর আসবাব নিয়ে যাওয়ার অভিযোগ রয়েছে তাদের বিরুদ্ধে। সরকার এখনো তাদের কাছে সাড়ে ১৩ লাখ টাকা ভাড়া পায়। এরপর হাসপাতালটি সিলগালা করে দেয় তত্কালীন মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্টের কল্যাণ বিভাগ। এখন হাসপাতালটি পরিত্যক্ত অবস্থায় রয়েছে।

এরপর দু’বছর আগে এই যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা কমপ্লেক্সের পরিত্যক্ত অবস্থায় থাকা জমিতে মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য নতুন করে একটি আবাসিক ভবন ও পুনর্বাসনের উদ্যোগ নেওয়া হয় সরকারের তরফ থেকে। মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় এই পরিকল্পনার অংশ হিসেবে এখানে মুক্তিযোদ্ধা পল্লী নির্মাণের উদ্যোগ নেয়।



রাইজিংবিডি/ঢাকা/২৪ ডিসেম্বর ২০১৭/হাসান/মুশফিক

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়