ঢাকা     বৃহস্পতিবার   ২৫ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১২ ১৪৩১

পরিচ্ছন্ন বিমানবন্দর, এবার হারানো লাগেজ পৌঁছে যাবে যাত্রীর বাড়ি

হাসান মাহামুদ || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৯:০০, ২০ জানুয়ারি ২০১৮   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
পরিচ্ছন্ন বিমানবন্দর, এবার হারানো লাগেজ পৌঁছে যাবে যাত্রীর বাড়ি

বিমানবন্দর টার্মিনাল পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন (ছবি : শাহীন ভুঁইয়া)

হাসান মাহামুদ : একটা সময় ছিল যখন বিমানবন্দরে চিৎকার-চেঁচামেঁচি, ময়লা পড়ে থাকা, যাত্রী হয়রানি, লাগেজ হারানো ছিল নিত্যকার চিত্র। এসব এখন অতীত। এর পরিবর্তে নতুন নতুন পদ্ধতি চালু, সামাজিক সচেতনতা বাড়ানোর মাধ্যমে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা নিশ্চিত করা এবং দায়িত্বশীলদের আন্তরিকতায় বদলে গেছে পুরনো দৃশ্যপট।

এখন বিমানবন্দরের ভেতরে-বাইরে কোথাও ময়লা বা আবর্জনা পড়ে থাকতে দেখা যায় না। যে কেউ যে কোন সময় ম্যাজিস্ট্রেট কোর্টে ফোন দিয়ে সেবা নিতে পারছেন। এমনকি আর কয়েকদিন পর থেকে যাত্রীদের হারানো লাগেজ পৌঁছে যাবে বাড়িতেই। এ জন্য ‘হোম সার্ভিস’ চালু করতে যাচ্ছে বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষ। এই হোম সার্ভিসের জন্য যাত্রীকে কোনো অর্থ পরিশোধ করতে হবে না। তা পরিশোধ করবে সংশ্লিষ্ট বিমান কর্তৃপক্ষ।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বিমানবন্দরে গত কয়েক মাসে বেশকিছু ইতিবাচক উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এসবের সফলতাও পাচ্ছে বিমানবন্দর। এর মাধ্যমে দেশের ভাবমূর্তি আরো উজ্জ্বল হচ্ছে। আগে যেখানে বিদেশীরা বিমানবন্দরে ময়লা আবর্জনা দেখে বিরক্ত হতো, তারা এখন ময়লা সংগ্রহের পদ্ধতি দেখে ‘ওহ রিসাইক্লিং’ বলে বিস্ময় প্রকাশ করছেন।

অনেক ক্ষেত্রে যাত্রীর চাপ কিংবা অন্যান্য কারণে যাত্রীদের ব্যাগ-লাগেজ পরে আসে। এক সময় মনে করা হতো, বিমানে ব্যাগ হারিয়ে গেছে। এই মানসিকতার বদল হয়েছে। এখন ‘ব্যাগ বিলম্বে এলেও তা পাওয়া যায়’- এ ধারণা পোষণ করেন যাত্রীরা। এবার নতুন কার্যক্রম সংযোজন হতে যাচ্ছে এর সঙ্গে। বিলম্বে কোনো ব্যাগ এলে যাত্রীকে এর জন্য আর অপেক্ষা করতে হবে না। ‘হোম সার্ভিস’ এর মাধ্যমে বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষই ব্যাগ-লাগেজ পৌঁছে দেবে যাত্রীর বাড়িতে।
 


এরই মধ্যে ‘হোম সার্ভিস’ এর যাবতীয় কর্মপরিকল্পনা সম্পন্ন হয়েছে। হযরত শাহজালাল (র.) আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষ, সিভিল এভিয়েশন এবং বিমানবন্দর কাস্টমস- এর মধ্যে আলোচনা হয়েছে কয়েক দফায়। বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষের কাজ কি হবে, সিভিল এভিয়েশনের দায়িত্ব কি হবে এবং কাস্টমস ক্লিয়ারেন্স কিভাবে হবে এসব বিষয়ে করণীয় চূড়ান্ত হয়েছে। চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি বা মার্চ মাস থেকে এই সার্ভিস শুরু হতে যাচ্ছে বিমানবন্দরে।

বিমানবন্দরের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মোহাম্মদ ইউসুফ রাইজিংবিডিকে বলেন, ‘গত দুই বছর ধরে পরিকল্পনাটি নিয়ে কাজ করা হচ্ছে। ইতিমধ্যে সব ধরনের প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়েছে। শুধু থার্ড পার্টির পরিচালন ব্যয় নির্দিষ্ট করা নিয়ে এখন আলোচনা চলছে। হারানো লাগেজ বাসায় পৌঁছে দেওয়া হবে থার্ড পার্টির মাধ্যমে। শিগগিরই এ বিষয়ে টেন্ডার দেওয়া হবে। এরপর নেওয়া হবে চূড়ান্ত পদক্ষেপ।’

২০১৮ সালের প্রথম দিন থেকে এই কর্মসূচি চালু করার পরিকল্পনা ছিল কর্তৃপক্ষের। কিন্তু বিভিন্ন পক্ষের সঙ্গে আলোচনায় কিছুটা সময় লাগছে। আশা করা হচ্ছে, আগামী মাস কিংবা মার্চে এই কর্মসূচি চালু করা যাবে।

‘ময়লা দিন টাকা নিন’ প্রজেক্ট চালুর মাধ্যমে বিমানবন্দরকে পরিচ্ছন্ন করে এরই মধ্যে সাধুবাদ পেয়েছেন এই কর্মকর্তা। নতুন প্রবর্তিত ‘হোম সার্ভিস’ নামের এই কর্মসূচিও তেমনি সাধুবাদ পাবে বলে আশা করা হচ্ছে।
 


নতুন কর্মসূচির বিষয়ে তিনি আরো বলেন, ‘সার্ভিসটি ঠিক মতো সম্পন্ন করতে পারার লক্ষ্যে বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষ কিছু নির্দেশনা দিয়ে দিয়েছে। ব্যাগে কাস্টমেবল পণ্য থাকলে কি হবে, নন-কাস্টমেবল পণ্য থাকলে কীভাবে কি করা হবে- এসব নিয়ে আলোচনা হয়েছে।’

তিনি বলেন, ‘বর্তমানে ব্যাগ পাওয়া না গেলে কাস্টমস থেকে একটি পিআর ফরম পূরণ করে দিতে হয়। আমরা নতুন প্রক্রিয়ার জন্য একটি ডিক্লারেশন ফরম পূরণ করে নিচ্ছি। সেখানে উল্লেখ থাকবে, ব্যাগে নন-কাস্টমেবল আছে কী না। কাস্টমস একটি ডিক্লারেশন ফরমের সঙ্গে ব্যাগ মিলিয়ে দেখবে। ব্যাগে কোনো রকম নন-কাস্টমেবল পণ্য থাকলে এটি হোম সার্ভিসের মাধ্যমে যাত্রীর ঠিকানায় পাঠানো হবে।

আর ব্যাগে যদি কোনো রকম আপত্তিকর পণ্য পাওয়া যায়, কিংবা ডিক্লারেশন ফরম পূরণ না করা থাকে তাহলে সেসব ব্যাগ যাত্রীকে নিজে উপস্থিত থেকে গ্রহণ করতে হবে এবং এ সংক্রান্ত কাস্টমস প্রক্রিয়া তাকে সম্পন্ন করতে হবে।’

জনপ্রিয়তা পেয়েছে ‘ময়লা দিন টাকা নিন’ প্রকল্প: হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর এলাকা পরিচ্ছন্ন রাখতে গত বছরের অক্টোবরে অভিনব উদ্যোগ গ্রহণ করেছিলেন বিমানবন্দরের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মোহাম্মদ ইউসুফ। মাত্র কয়েক মাসের ব্যবধানে অভিনব এই কৌশলের ফলে আবর্জনামুক্ত হয়ে গেছে শাহজালাল বিমানবন্দর। এখন বিমানবন্দরের ভেতর-বাহির ঝকঝকে পরিষ্কার। কেউ আর যেখানে সেখানে ময়লা ফেলে না।
 


প্রকল্পটি ঘোষণা করার পরই এই উদ্যোগকে স্বাগত জানায় বিমানবন্দরের কর্মীরা। সোশ্যাল মিডিয়াতেও বেশ আলোড়ন ফেলে ‘ময়লা দিন টাকা নিন’ উদ্যোগ। উদ্যোগের অংশ হিসেবে বিমানবন্দরে বিপনি কেন্দ্রগুলোতে পণ্যের মোড়ক ফেরত দিলে ক্রেতাকে দেওয়া হয় পাঁচ টাকা। এই পাঁচ টাকা দোকানদার পণ্য বিক্রির সময় বাড়তি হিসেবে রাখেন। আর কুড়িয়ে পাওয়া কোনো বর্জ্য দোকানদারকে ফেরত দিলে পরিচ্ছন্ন কর্মীকে দিতে হয় ১০ টাকা। এক্ষেত্রে বাড়তি ৫ টাকার বিষয়ে ব্যাখ্যা হচ্ছে, দোকানদার হয়তো বিক্রির সময় সচেতন করেননি ক্রেতাকে, তাই আক্কেল সেলামী হিসেবে বাড়তি ৫ টাকা দিতে হবে পরিচ্ছন্ন কর্মীকে।

এছাড়াও বিমানবন্দর এলাকার স্টেশনারি দোকানগুলোতে ঝুলছে কড়া নির্দেশনার ফেস্টুন। যেখানে লেখা রয়েছে, এয়ারপোর্ট এলাকায় যেকোন ধরণের ময়লা/বর্জ্য নির্ধারিত ডাস্টবিনের বাইরে ফেললে ৫শ’ টাকা জরিমানা অথবা ১ বছরের কারাদণ্ড হতে পারে।

নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মোহাম্মদ ইউসুফ বলেন, ‘তিন বছর ধরে আমি শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে কর্মরত। প্রথম দিকেই লক্ষ করেছিলাম বিমানবন্দরে এসে যাত্রী অথবা স্বজনেরা কিছু খেয়ে বর্জ্য ডাস্টবিনে ফেলছে না। ইচ্ছেমত যেখানে খুশি সেখানে বর্জ্য ফেলছে। বর্জ্যের কারণে এয়ারপোর্ট নোংরা হচ্ছিল। বাড়ছিল মাছি ও বিড়ালের উপদ্রব। তাদের মৌখিতভাবে সর্তক করলেও কোন কাজ হচ্ছিল না। তখন শুধু সচেতনতা বৃদ্ধির মাধ্যমে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন থাকার এ প্রজেক্ট দাঁড় করালাম।

আগে সিভিল এভিয়েশন দিনে তিনবার ঝাড়ু দিত পুরো বিমানবন্দর। এখন সারাদিনে একবারও ঝাড়ু দিতে হচ্ছে না।’

তিনি আরো বলেন, ‘গত ১৫ অক্টোবর এই প্রজেক্ট বৃত্তান্ত লিখেছিলাম, ১৬ অক্টোবর শুরু করছিলাম। আজ এটা একটি সফল প্রজেক্ট। সবাই এই প্রজেক্টকে স্বাগত জানিয়েছে। বিমানবন্দরে আগত যাত্রী ও স্বজনরাও মানছেন।’
 


বিমানবন্দরের এই প্রজেক্ট রাজধানীর অন্যান্য স্থানেও পরিচালনা করা যায় কীভাবে, এ বিষয়ে পরামর্শ চাইলে তিনি বলেন, ‘সামগ্রিকভাবে এই প্রজেক্ট বাস্তবায়ন করতে চাইলে কিছুটা কষ্টকর হবে। এ জন্য প্রয়োজন প্রতিষ্ঠান ভিত্তিক প্রকল্প হাতে নেওয়া। যেমন, ঢাকার সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, বিভিন্ন সংস্থা, হাতপাতাল এসব স্থানে নিজেদের মাধ্যমে এই ধরনের প্রকল্প পরিচালনা করতে হবে। যেমন: কোনো কলেজ নিজেদের জন্য স্থান নির্দিষ্ট করে দেবে, নিয়ম ঠিক করে দেবে। এভাবে আলাদা আলাদা ইউনিটভিত্তিক কাজ করা যেতে পারে। এক সাথে পুরো ঢাকায় একটি নির্দেশনা দিয়ে এই ধরনের প্রকল্প বাস্তবায়ন করা চ্যালেঞ্জিং হবে।’

প্রকল্পের সফলতার বিষয়ে তিনি বলেন, ‘প্রকল্পটি কতটা সফল হয়েছে, তা বিমানবন্দরে আসলেই বোঝা যাবে। আমরা অন্তত এটা বলতে পারি, এখানকার  মানুষের মধ্যে আমরা একটি মানসিকতা তৈরি করতে পেরেছি যে, ময়লা নির্দিষ্ট স্থানে ফেলতে হবে। এই প্রকল্পের কাজ শেষ হয়ে গেলেও এই যে মানসিকতা তৈরি হচ্ছে, তা কিন্তু থেকে যাবে।’

তিনি বলেন, ‘এখন ফরেনাররা আমাদের ময়লা সংগ্রহের পদ্ধতি দেখে কমেন্টস করে, তোমরাও তাহলে রিসাইক্লিং শুরু করেছো? তারা অবাক হয়, মুগ্ধ হয়।’

মোহাম্মদ ইউসুফ জানান, শুধু গত এক বছরের সংগৃহীত ময়লা বিক্রি করা গেছে ৪৩ লাখ টাকায়।

এখন বিমানবন্দরে আগত সকল যাত্রী ও সংশ্লিষ্টরা কিছু খাওয়ার পর খালি বোতল, কাপ, প্যাকেট ইত্যাদি ফেরত দিচ্ছে কিংবা দোকানের বিনে ফেলছে। এসব খালি বোতল, কাপ, প্যাকেট ইত্যাদি ফেলার জন্য বিমানবন্দরে পর্যাপ্ত বীন সরবরাহ করেছে দেশের সর্ববৃহৎ ইলেকট্রিক্যাল, ইলেকট্রনিক্স, হোম অ্যাপ্লায়েন্স, অটোমোবাইলস ও টেলিকমিউনিকেশন পণ্য প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান ওয়ালটন গ্রুপ।
 


স্বল্প সময়ে সেবা নিশ্চিত করতে ফোন ও ফেসবুকভিত্তিক সেবা: যাত্রী ও সংশ্লিষ্টদের সেবায় চালু করা হয়েছে ফোন সেবা। সেখানে সরাসরি ফোন করা যায় বিমানবন্দরের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের কাছেই।

এই মোবাইলে ফোনে সেবার বিষয়ে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মোহাম্মদ ইউসুফ রাইজিংবিডিকে বলেন, ‘যখন দেশের কোনো নাম্বার থেকে ফোন আসে, তাকে আমরা বেশি প্রায়োরিটি দেই। কারণ, এই সমস্যার দ্রুত সমাধান আমরা হয়তো দিতে পারবো। এরপর বিদেশী ফোনগুলোতে গুরুত্ব দেওয়া হয়।’

যাত্রীসেবা নিশ্চিত করতে এবং অভিযোগ জানানোর লক্ষ্যে চালু করা হয়েছে ফেসবুকভিত্তিক পেজ ‘Magistrates All Airports of Bangladesh’। এই পেজের মাধ্যমে সেবার বাইরে বিভিন্ন রকম পরামর্শও দেওয়া হয় যাত্রী ও সংশ্লিষ্টদের উদ্দেশ্যে। এছাড়া সরাসরি যোগাযোগ করা যায় বিমানবন্দরের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট কার্যালয়ে।



রাইজিংবিডি/ঢাকা/২০ জানুয়ারি ২০১৮/হাসান/শাহনেওয়াজ

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়