ঢাকা     শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৭ ১৪৩১

শোডাউন ছাড়া কোনো চমক নেই এরশাদের

মোহাম্মদ নঈমুদ্দীন || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৪:৫৯, ২০ অক্টোবর ২০১৮   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
শোডাউন ছাড়া কোনো চমক নেই এরশাদের

মোহাম্মদ নঈমু্দ্দীন : কোটি কোটি টাকা খরচ করে রাজধানীর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে মহাসমাবেশ করলেও দেশ ও জাতির উদ্দেশে জাতীয় পার্টি (জাপা) ও সম্মিলিত জাতীয় জোটের চেয়ারম্যান হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদের কোনো বার্তা নেই। জাতীয় নির্বাচন নিয়ে সংশয় প্রকাশ ও জোটের ব্যানারে ৩০০ আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করাসহ তিনি যেসব বক্তব্য দিয়েছেন, তার সবই আগের বক্তব্যের পুনরাবৃত্তি। মূলত বড় ধরনের শোডাউন করা ছাড়া এই মহাসমাবেশে কোনো চমক নেই।

মহাসমাবেশের মধ্য দিয়ে জাতীয় পার্টি ও সম্মিলিত জাতীয় জোট নির্বাচনের আগে রাজধানী ঢাকায় বড় ধরনের শোডাউন করেছে। জাপা ও জোটের নেতারা টাকা খরচ করে সারা দেশ থেকে লোকজন নিয়ে এসে কর্মসূচি সফল করেছেন। মনোনয়নপ্রত্যাশী নেতারা সর্বোচ্চ শোডাউন করেছেন মহাসমাবেশে।

শনিবার সকাল ১০টা থেকে রাজধানীর পল্টন, প্রেসক্লাব, মৎস্যভবন ও সোহরাওয়ার্দী উদ্যান এলাকায় জাপার বর্তমান সংসদ সদস্য, মনোনয়নপ্রত্যাশী নেতা ও জোটের শরিক দল ইসলামী ফ্রন্ট, খেলাফত মজলিসের মিছিলে ভরে যায়।

জাতীয় পার্টির ঢাকা মহানগর দক্ষিণের সভাপতি সৈয়দ আবু হোসেন বাবলা এমপি, পার্টির মহাসচিব এ বি এম রুহুল আমিন হাওলাদার, আল্লামা এম এ মান্নান ও এম এ মতিনের ইসলামী ফ্রন্ট, নারায়ণগঞ্জের সংসদ সদস্য লিয়াকত হোসেন খোকা এমপি, সেলিম ওসমান এমপি, জাপা উত্তরের সভাপতি এস এম ফয়সল চিশতি ও সেক্রেটারি শফিকুল ইসলাম সেন্টু, ঢাকার নবাবগঞ্জ-দোহার থেকে অ্যাডভোকেট সালমা ইসলাম, ঢাকা-৬ থেকে অ্যাডভোকেট কাজী ফিরোজ রশীদ, ঢাকা-৫ থেকে মীর আব্দুস সবুর আসুদ, নারায়ণগঞ্জ থেকে প্রয়াত নাসিম ওসমানের স্ত্রী পারভিন ওসমান, সোনারগাঁও থেকে অনন্যা হোসেন মৌসুমী ও খেলাফত মজলিসের মিছিল শোডাউন ছিল চোখে পড়ার মতো।

মহাসমাবেশ শুরুর আগেই সকাল ৭টার মধ্যে জাপা মহাসচিব রুহুল আমিন হাওলাদার ও তার স্ত্রী নাসরিন জাহান রত্না হাওলাদার এমপির নেতৃত্বে বরিশাল বাকেরগঞ্জ ও পটুয়াখালী থেকে প্রায় ১০ হাজার নেতাকর্মী সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে প্রবেশ করেন। তবে মহাসমাবেশে সবচেয়ে বড় শোডাউন করেন ঢাকা মহানগর দক্ষিণের সভাপতি সৈয়দ আবু হোসেন বাবলা এমপি। তার নির্বাচনী এলাকা শ্যামপুর–কদমতলী থানা জাতীয় পার্টি এবং অঙ্গ-সহযোগী সংগঠনের ১০ হাজারের বেশি নেতাকর্মী বিশালাকার লাঙল, এরশাদ ও বাবলার ছবি নিয়ে নান্দনিক সাজে বিশাল মিছিল সহকারে সমাবেশে যোগ দেন। মিছিলে নেতৃত্ব দেন জাতীয় পার্টির কেন্দ্রীয় নেতা সুজন দে, শেখ মাসুক রহমান, স্থানীয় নেতা কাওসার আহমেদ, ইব্রাহীম মোল্লা ও শামসুজ্জামান কাজল।

এমপি বাবলার অনুসারী নেতাকর্মীরা দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে সকাল ১০টা থেকে রাজধানীর পল্টন ও প্রেসক্লাবে অবস্থান নেয়। নেতাকর্মী ও সমর্থকদের উপস্থিতি একপর্যায়ে পল্টন থেকে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়ে। তাদের মিছিলের কারণে পল্টন মোড়ে দুপুর ১১টার পরে যান চলাচল বন্ধ হয়। এতে তীব্র যানজটের সৃষ্টি হয়।

সকাল ১০টার আগেই শরিক দল ইসলামী ফ্রন্টের নেতাকর্মীরা বিশিল মিছিল নিয়ে সমাবেশে যোগ দেন। এ সময় দলটির যুগ্ম মহাসচিব এম এ মোমেন, যুবসেনার ফিরোজ আলম, ফ্রন্ট নেতা মাসুদ হোসাইন কাদেরি, মুহাম্মদ আব্দুল হাকিমসহ দলটির শীর্ষ নেতারা উপস্থিত ছিলেন। বিশেষ করে ফ্রন্টের চেয়ারম্যান আল্লামা এম এ মান্নান ও মহাসচিব এম এ মতিন, জাপা মহাসচিব এ বি এম রুহুল আমিন হাওলাদারকে ফ্রন্টের নিজস্ব পোশাক পরিহিত প্রশিক্ষিত স্বেচ্ছাসেবক টিম পাহাড়া দিয়ে যেভাবে মহাসমাবেশে নিয়ে গেছেন তা সবার দৃষ্টি কাড়ে।

মহাসমাবেশে গাজীপুরের কালিগঞ্জ থেকে আজম খান, মানিকগঞ্জ থেকে জহিরুল আলম রুবেল, কুমিল্লা থেকে আমির হোসেন এমপি, বরিশাল থেকে ইকবাল তাপস, ময়মনসিংহ থেকে ফখরুল ইমাম এমপি, কুমিল্লা থেকে এটি এম আলমগীর, টাঙ্গাইল থেকে আশরাফ সিদ্দিকী, রাজধানীর বাড্ডা-সবুজবাগ থেকে অধ্যাপক দেলোয়ার হোসেন, টাঙ্গাইল থেকে মনির হোসেন ও মোজাম্মেল, চট্টগ্রাম থেকে মাহমুদুল ইসলাম চৌধুরী ও সোলাইমান আলম শেঠ, শামসুল আলম মাস্টার, ব্রাহ্মণবাড়িয়া থেকে কাজী মামুন, সিলেট থেকে ইয়াহইয়া চৌধুরী এমপি, বগুড়া থেকে নুরুল ইসলাম ওমর এমপি, কিশোরগঞ্জ থেকে মুজিবুল হক চুন্নু এমপি, পাবনা থেকে সরদার শাহাজাহান, ব্রাহ্মণবাড়িয়া থেকে ফ্রন্টের ইসলাম উদ্দিন দুলাল, চাঁদপুর থেকে আল্লামা আবু সুফিয়ান কাদেরি, চট্টগ্রামের চন্দনাইশ-সাতকানিয়া থেকে সওম আব্দুস সামাদ, চাঁদপুর থেকে জাপার ইমরান মিয়া, নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জ থেকে সাইফুল ইসলাম, ফেনী থেকে নাজমা আখতার ও রিন্টু আনোয়ার, নাটোর থেকে এম এ তালহা, ছাত্রসমাজের প্রাক্তন সেক্রেটারি আবুল কাসেম রিপন, প্রাক্তন সভাপতি ইফতিখার হাসান, মানিকগঞ্জ থেকে এম এ মান্নান, গাজীপুর থেকে ইস্রাফিল আলম খোকন, গাজীপুর থেকে প্রাক্তন সচিব এম নিয়াজুদ্দিন মিয়া, সিলেট থেকে আতিকুর রহমান আতিক, সিতাকুন্ড থেকে দিদারুল কবির দিদার, গাইবান্ধা থেকে ব্যারিস্টার দিলারা খন্দকার লোকজন নিয়ে মহাসমাবেশে শোডাউন করেছেন।



এছাড়া, জাপার প্রেসিডিয়াম সদস্য সাহিদুর রহমান টেপা ও লিয়াকত হোসেন চাকলাদারের নেতৃত্বে কৃষক পার্টি, এ কে এম আশরাফুজ্জামানের নেতৃত্বে শ্রমিক পার্টি, বেলাল হোসেনের নেতৃত্বে স্বেচ্ছাসেবক পার্টি, আলমগীর সিকদার লোটন ও ফখরুল আহসান শাহজাদার নেতৃত্বে যুবসংহতি, মোড়ল জিয়াউর রহমানের নেতৃত্বে ছাত্রসমাজসহ অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনগুলো আলাদা মিছিল নিয়ে সমাবেশে আসে।

মিছিল নিয়ে সমাবেশে যোগ দেয় মহিলা পার্টিও। মহিলা পার্টির নেত্রী ডা. সেলিমা রহমান, অ্যাডভোকেট শহিদা রহমান রিঙ্কু, মানোয়ার তাহের মানু, মাহমুদুর রহমান মুন্নী, পারভিন তারেক, হেনা খান, তাসলিমা আকবার রুনা, রিতু নূরসহ নেত্রীরা মিছিল নিয়ে সমাবেশে যোগ দেন। 

এরশাদের প্রেস উইং এর অবহেলায় গণমাধ্যমকর্মীদের চরম ভোগান্তি :
জাতীয় পার্টি চেয়ারম্যান হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদের শক্তিশালী একটি প্রেস উইং রয়েছে। জাতীয় পার্টির খবরাখবর নিয়ে সবসময় যোগাযোগ করেন এরশাদের প্রেস অ্যান্ড পলিটিক্যাল সেক্রেটারি সুনীল শুভরায়, ডেপুটি প্রেস সেক্রেটারি দেলোয়ার জালালী, প্রেস উইং এর আব্দুর রহিম, জাপা দপ্তর সম্পাদক সুলতান মাহমুদ ও যুগ্ম দপ্তর সম্পাদক এম এ রাজ্জাক খান। যেকোনো নিউজ নিয়ে তারা প্রত্যেকেই যোগাযোগ করেন গণমাধ্যমকর্মীদের সঙ্গে। কিন্তু ব্যতিক্রম ছিল কেবল এরশাদের সবচেয়ে বড় কর্মসূচি সোহারওয়ার্দী উদ্যানে জোটের মহাসমাবেশে।

সকাল থেকেই মহাসমাবেশে শেষ হওয়া পর্যন্ত একবারের জন্যও তারা আসেননি গণমাধ্যম কর্মীদের জন্য নির্ধারিত টেবিলে। সকাল ১০টার আগেই গণমাধ্যমকর্মীদের জন্য নির্ধারিত টেবিল বহিরাগত জাপা নেতাকর্মীদের দখলে চলে যায়। দীর্ঘ এক ঘণ্টা প্রচণ্ড রোদে দাঁড়িয়ে ডাকাডাকির পর দলের যুগ্ম মহাসচিব গোলাম মোহাম্মদ রাজু, আলমগীর সিকদার লোটন ও সুমন আশরাফের সহযোগিতায় চেয়ার সংগ্রহ করে বসার সুযোগ পান সাংবাদিকরা। চেয়ার টেবিল থাকলেও এরশাদের প্রেস উইং এর কেউ না থাকায় কর্মরত গণমাধ্যমকর্মীদের অনেকেই বসতে পারেননি। বসা নিয়ে সাংবাদিকদের সঙ্গে অশোভন আচরণ করেন দলের উশৃঙ্খল নেতাকর্মীরা। রোদে দাঁড়িয়ে নেতাকর্মীদের ভিড়ে ঠেলাঠেলি করেই সংবাদ সংগ্রহ করেন সাংবাদিকরা। প্রেস উইং এর দায়িত্বপ্রাপ্তদের কাউকে সমাবেশ চলা পর্যন্ত ধারে-কাছে দেখা যায়নি। সাংবাদিকদের অসুবিধা হচ্ছে কিনা তার খোঁজ নেওয়ার কেউ ছিল না। এভাবেই চরম ভোগান্তিতে মহাসমাবেশের সংবাদ সংগ্রহ করেন গণমাধ্যমকর্মীরা।

মঞ্চে ও ময়দানে চরম বিশৃঙ্খলা :
রাজধানীর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে এরশাদের মহাসমাবেশে ব্যাপক শোডাউন হলেও মঞ্চে যে কেউ উঠে যাওয়া, নেতাকর্মীদের ধাক্কাধাক্কি, কর্মীদের শোডাউনে আধিপত্য বিস্তার, নিষেধ করার পরও বক্তৃতা চলাকালে স্লোগান দেওয়াসহ নানা রকম বিশৃঙ্খলা দেখা গেছে। এত বড় কর্মসূচিতে এ ধরনের বিশৃঙ্খলায় মহাসমাবেশে নেতিবাচক প্রভাব পড়ে এবং দলের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হয়।

মহাসমাবেশ চলাকালে কোনো প্রকার ডেকোরাম ছাড়াই বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাকর্মীকে সমাবেশের মূল মঞ্চে দেখা গেছে। মঞ্চে নির্ধারিত নেতা ছাড়া কারো বসার সুযোগ থাকার কথা নয় এবং এ ব্যপারে এরশাদের কঠোর নির্দেশনাও ছিল, কিন্তু কে শোনে কার কথা। যে যেভাবে পেরেছেন মঞ্চে জায়গা করে নিয়েছেন। এরশাদের পেছনে ছবি তোলার জন্য তাদের কখনো এদিক কখনো সেদিক দৌড়ঝাপ করতে দেখা যায়। তাদের কারণে দলের ও জোটের অনেক সিনিয়র নেতা মঞ্চে উঠতে পারেননি। অনেকেই ক্ষুব্ধ হয়ে মাঠে দাঁড়িয়ে এরশাদের বক্তব্য শোনেন।

শুধু তাই নয়, অনেক দেরিতে মিছিল নিয়ে মহাসমাবেশে যোগ দিলেও নেতাকর্মীর মিছিল নিয়ে অনেক নেতাই মঞ্চের সামনে বেষ্টনীর ভেতরে ধাক্কা দিয়ে প্রবেশ করে। উপস্থিত নেতাদের ঠেলা দিয়ে স্লোগানে শোডাউন করার চেষ্টা করে। এতে ধাক্কাধাক্কি ও হুড়োহুড়ির ঘটনাও ঘটে। হৈ চৈ বিশৃঙ্খলায় সমাবেশের সৌন্দর্য নষ্ট হয়।

মহাসমাবেশ চলাকালে এরশাদের বক্তব্যের সময় হঠাৎ করে উপস্থিত কর্মী-সমর্থকরা নিজ নেতাদের নামে স্লোগান দিতে থাকলে আরেক দফা বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হয়। এতে বক্তৃতা থামাতে হয় হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদকে। একপর্যায়ে স্লোগান বন্ধ করতে বলেন তিনি। কিন্তু তারপরও চলে স্লোগান। এ সময় নেতাকর্মীরা ব্যানার-ফেস্টুন উঁচিয়ে ধরলে তা নামিয়ে ফেলার নির্দেশ দেন এরশাদ। কিন্তু কে শোনে কার কথা।  নেতাকর্মীদের এমন আচরণে হতাশ হন তিনি। দুঃখ করে বলেন, কেউ কারো কথা মানে না।





রাইজিং‌বি‌ডি/ঢাকা/২০ অ‌ক্টোবর ২০১৮/নঈমুদ্দীন/রফিক

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়