সৌদিতে বাংলাদেশি পাসপোর্টে রোহিঙ্গা : রহস্য উন্মোচনে দুদক
এম এ রহমান : মিয়ানমার থেকে বিতাড়িত রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর একটি অংশ পালিয়ে বাংলাদেশের জাল জাতীয় পরিচয়পত্রের মাধ্যমে বাংলাদেশি পাসপোর্ট নিয়ে বিদেশ গমন করছে, এমন অভিযোগ উঠেছে বেশ কিছুদিন ধরে। বিশেষ করে সৌদি আরব থেকে বাংলাদেশি পাসপোর্টধারী ১৩ রোহিঙ্গাকে এই দেশে ফেরত পাঠানোর পর বিষয়টি নতুন করে নজর কেড়েছে সবার।
রোহিঙ্গারা কোন মাধ্যমে ও কী প্রক্রিয়ায় জাতীয় পরিচয়পত্রের মাধ্যমে বাংলাদেশি পাসপোর্ট নিয়ে বিদেশে যাচ্ছে এবং এই প্রক্রিয়ার সাথে কারা জড়িত এবার সেই রহস্য উন্মোচনে অনুসন্ধানে নেমেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)।
মূলত ১৩ রোহিঙ্গার নাম ও পরিচয়কে সামনে রেখে অনুসন্ধানের কাজ শুরু করেছে সংস্থাটি। এর মধ্যে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে অনুসন্ধান কর্মকর্তা। দুদক উপপরিচালক সৈয়দ আহমেদকে দেওয়া হয়েছে অনুসন্ধানের দায়িত্ব। দুদকের ঊর্ধ্বতন একটি সূত্র রাইজিংবিডিকে এসব তথ্য নিশ্চিত করেছে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে দুদকের পরিচালক পদমর্যাদার এক কর্মকর্তা এ বিষয়ে রাইজিংবিডিকে বলেন, ‘সম্প্রতি বিভিন্ন মিডিয়া ও প্রাপ্ত অভিযোগ থেকে আমরা বিষয়টি জানতে পেরেছি। বিষয়টি অনেকটা আতঙ্কেরও বটে। কীভাবে রোহিঙ্গারা বাংলাদেশের জাতীয় পরিচায়পত্র ও বাংলাদেশি পাসপোর্টের মালিক হলো সেটাই বড় প্রশ্ন। এতে বহির্বিশ্বে বাংলাদেশিদের সুনাম ক্ষুণ্ন হচ্ছে। বিষয়টি গুরুত্বের সাথে গ্রহণ করেছে কমিশন।’
তিনি বলেন, ‘অভিযোগ অনুসন্ধানে এরই মধ্যে পাসপোর্ট অধিদপ্তর ও নির্বাচন কমিশনসহ সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানে রোহিঙ্গাদের নাম উল্লেখ করে চিঠি দেওয়া হয়েছে। কাগজপত্র হাতে পাওয়ার পর বিষয়টি খতিয়ে দেখা হবে। এর সঙ্গে যাদেরই সংশ্লিষ্টতা পাওয়া যাবে তাদেরকে আইনের আওতায় আনা হবে।’
এ বিষয়ে দুদক চেয়ারম্যান ইকবাল মাহমুদ রাইজিংবিডিকে বলেন, ‘আমরা এ বিষয়ে ইতোমধ্যে অনুসন্ধানের সিদ্ধান্ত নিয়েছি। বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে দেখা হচ্ছে। কথা হচ্ছে রহিঙ্গাদের পাসপোর্ট ইস্যু করলো কারা? এটা খতিয়ে দেখা প্রয়োজন।;
তিনি বলেন, ‘আমি যখন এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকের (এডিবি) নির্বাহী পরিচালকের দায়িত্ব পালন করেছি তখনই অভিযোগ ছিল সৌদিতে অন্তত ২ লাখ রোহিঙ্গা রয়েছে, যারা বাংলাদেশি পাসপোর্ট ব্যবহার করছে। বিষয়টি উদ্বেগজনক। এখন অনুসন্ধান কর্মকর্তা রিপোর্ট জমা দিলে বিস্তারিত বলতে পারব। এর জন্য কারা দায়ী। ইউনিয়ন বা উপজেলা পরিষদের সদস্য, নাকি পাসপোর্ট অধিপ্তরের কেউ। কারা জড়িত সেটা খুঁজে বের করা দরকার।’
বিভিন্ন সূত্রে জানা যায়, গত ৭ জানুয়ারি সৌদি আরবের জেদ্দা থেকে বাংলাদেশ পাঠানো হয় ১৩ রোহিঙ্গাকে। ওই দিন রাত ২টার দিকে সৌদি এয়ারলাইন্সের এসভি ৮০২ ফ্লাইটে তারা হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে এসে পৌঁছায়। পরে তাদেরকে ইমিগ্রেশন পুলিশের হেফাজতে রাখা হয়। এ সময় তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়।
এ বিষয়ে পুলিশ সদর দপ্তরের সহকারী মহাপরিদর্শক (মিডিয়া) সোহেল রানা সাংবাদিকদের জানান, সৌদি আরব থেকে ফিরে আসা ওই ১৩ ব্যক্তি প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে জানিয়েছে, তারা মিয়ানমারের নাগরিক। বাংলাদেশি পাসপোর্ট নিয়ে সৌদি আরব গিয়েছিল। অবৈধভাবে পাসপোর্ট করা ও আইন না মানার কারণে তাদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
যে ১৩ জনকে ফেরত পাঠানো হয়েছে তারা হলেন- ওমর ফারুক, মোসালিম, মো আরিফ, আবদুল মজিদ, খাজা মাঈনুদ্দীন, হাসিবুর রহমান, নাজিম বিল্লাহ, জামাল হোসেন, শামসুল আলম, আমানউল্লাহ, বকুল, মিজানুর রহমান ও মোমিয়া। তারা নিজেদের চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, কুমিল্লা, বগুড়া, জয়পুরহাট, পাবনা, ঝিনাইদহ, মাদারীপুরের বাসিন্দা হিসেবে ঘোষণা দিয়ে পাসপোর্ট করেছে। তারা প্রত্যেকেই ওমরাহ বা হজের জন্য তিন মাসের ভিসা নিয়েছিলেন। নির্দিষ্ট সময় পরও দেশে ফিরে না যাওয়ায় সৌদি পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার হন এবং জেদ্দার সুমাইসি কারাগারে ছিলেন।
সূত্র বলেছে,বাংলাদেশি পাসপোর্টধারী ওই রোহিঙ্গা নাগরিকেরা শুধু কক্সবাজার বা চট্টগ্রাম নয়, দেশের উত্তরাঞ্চলীয় কয়েকটি জেলার স্থায়ী বাসিন্দা পরিচয়েও পাসপোর্ট করেছেন। পাসপোর্ট করতে জাতীয় পরিচয়পত্র প্রয়োজন এবং অনুমোদনের আগে পুলিশ পাসপোর্ট পেতে ইচ্ছুক ব্যক্তিদের সব তথ্য যাচাই-বাছাই করে থাকে। কিন্তু কাদের সহযোগিতায় রোহিঙ্গারা বাংলাদেশি পাসপোর্ট পেলেন, সেটাই বড় প্রশ্ন।
গত ৬ জানুয়ারি মিডল ইস্ট আই অনলাইন সৌদি আরব থেকে বাংলাদেশি পাসপোর্টধারী রোহিঙ্গাদের ঢাকায় পাঠানো হচ্ছে, এমন একটি খবর প্রথম প্রকাশ করেছিল। এর পরপরই এমন ঘটনা ঘটলো।
গত বছরের অক্টোবরের শেষ সপ্তাহে প্রকাশিত প্রতিবেদনে মিডল ইস্ট আই জানিয়েছে, কোনো অভিযোগ ছাড়াই সৌদি আরবে বেশ কয়েক বছর ধরে আটক রাখা হয়েছে কয়েকশ রোহিঙ্গা পুরুষ, নারী ও শিশুদের। এদের বেশিরভাগ ২০১১ সালের পর মিয়ানমারের নিপীড়ন এড়াতে ও জীবিকার তাগিদে তেল সমৃদ্ধ দেশটিতে পৌঁছায় ভুয়া পাসপোর্ট নিয়ে। ওই প্রতিবেদনে দাবি করা হয়েছিল, ইতোমধ্যে সৌদি আরব থেকে বাংলাদেশে রোহিঙ্গা পাঠানো শুরু হয়ে গেছে বলে জানান দেশটিতে আটক রোহিঙ্গারা। তারা জানান, প্রতিদিন ৫ থেকে ১০ জন রোহিঙ্গাকে বাংলাদেশে পাঠানো হচ্ছে।
রাইজিংবিডি/ঢাকা/৬ মার্চ ২০১৯/এম এ রহমান/সাইফুল
রাইজিংবিডি.কম
আরো পড়ুন