ঢাকা     শুক্রবার   ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৬ ১৪৩১

রেকর্ড কারদাতা ও রাজস্ব আদায়ে শঙ্কার বছর

এম এ রহমান মাসুম || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৪:০৪, ২৩ ডিসেম্বর ২০১৮   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
রেকর্ড কারদাতা ও রাজস্ব আদায়ে শঙ্কার বছর

এম এ রহমান মাসুম : রেকর্ড করদাতা সংগ্রহ, রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের বড় ধরণের শঙ্কা ও ভবিষ্যতে রাজস্ব আদায়ের সম্ভাবনার প্রসারিত পথ দেখিয়ে বছর শেষ করতে যাচ্ছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)।

বছরজুড়ে রাজস্ব আদায়ের বাড়তি চাপের নয়া চ্যালেঞ্জ, রেকর্ড ই-টিআইএন নিবন্ধন, মূল্য সংযোজন কর (ভ্যাট/মূসক) নিবন্ধনে গতি, স্বর্ণ নীতিমালা, কাস্টমস ও শুল্ক গোয়েন্দার অব্যাহত অভিযান ইত্যাদি বিষয় ছিল বেশ আলোচিত।

৩৮ লাখ করদাতার নতুন মাইলফলক: এনবিআর নানামুখী উদ্যোগে করদাতা সংগ্রহে বড় ধরণের সাফল্য অব্যাহত রেখেছে। আয়কর মেলা, বিকেন্দ্রীকরণ আয়কর মেলা ও কর সপ্তাহসহ নানা আয়োজনে করদাতাদের কাছ পেয়েছে বিপুল সাড়া। এরই মধ্যে করদাতা সনাক্তকরণ নম্বর বা ই-টিআইএনধারীর সংখ্যা ৩৮ লাখ ছাড়িয়েছে। মাত্র ৪ বছরে করদাতার সংখ্যা তিনগুণের বেশি বৃদ্ধি পেয়েছে। ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত ই-টিআইএনধারীর সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩৮ লাখ ১৬ হাজার। বেড়েছে রিটার্ন দাখিলের সংখ্যাও। এরই মধ্যে রিটার্ন দাখিল ১৭ লাখ ছাড়িয়েছে। এনবিআর চেয়ারম্যান আশা প্রকাশ করেছেন চলতি অর্থবছরে আয়কর রিটার্ন দাখিলের সংখ্যা ৪০ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়ে ২২ থেকে ২৪ লাখ হতে পারে।

রাজস্ব আদায়ে বড় ধরনের ঘাটতির মুখে: ২০১৮-২০১৯ অর্থবছরে এনবিআরকে রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রা দেওয়া হয় ২ লাখ ৯৬ হাজার ২০১ কোটি টাকা। অর্থবছরের পাঁচ মাসে নভেম্বর পর্যন্ত প্রায় ১ লাখ ১ হাজার ৭০৪ কোটি টাকা লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে রাজস্ব আদায় হয়েছে (সাময়িক হিসাব) ৭৭ হাজার ৯৩৫ কোটি ৮২ লাখ টাকা। লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের হার প্রায় ৭৬.৬৩। ঘাটতি প্রায় ২৩ হাজার ৭৬৮ টাকা। আর প্রবৃদ্ধি ৪.৮৪ শতাংশ। গত অর্থবছরের ওই সময়ে আদায় ছিল ৭৪ হাজার ৩৩৬ কোটি ৫৯ লাখ টাকা। অন্যদিকে বিদায়ী ২০১৭-১৮ অর্থবছরে ১৯ হাজার কোটি টাকার বেশি রাজস্ব ঘাটতি নিয়ে অর্থবছর শেষ করেছিল এনবিআর। যদিও রাজস্ব আদায়ে ১৯ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জিত হয়।

এ বিষয়ে এনবিআর চেয়ারম্যান মো. মোশাররফ হোসেন ভূঁইয়া বলেন, ‘রাজস্ব আয় বাড়াতে আয়কর, কাস্টমস ও ভ্যাট তিন বিভাগকে অটোমেশনের আওতায় আনা হচ্ছে। তবে, অটোমেশন কার্যক্রম পুরোপুরি বাস্তবায়ন না হওয়া পর্যন্ত আদায় প্রক্রিয়া আরো জোরদার করা হবে।

নতুন চ্যালেঞ্জে রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রা: ২০১৮-২০১৯ অর্থবছরের বাজেটে জাতীয় রাজস্ব র্বোডকে ২ লাখ ৯৬ হাজার ২০১ কোটি টাকা লক্ষ্যমাত্রা দেওয়া হয়েছে। যা জিডিপির ১১.৭ শতাংশ। এর মধ্যে সর্বোচ্চ লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে মূল্য সংযোজন করে (মূসক/ভ্যাট)১ লাখ ১০ হাজার ৫৪৩ কোটি টাকা। এরপর আয়কর ও অন্যান্য প্রত্যক্ষ করে ১ লাখ দুই হাজার ২০১ কোটি টাকা ও আমদানি-রপ্তানি শুল্কে ৮৩ হাজার ৪৫৭ কোটি টাকা। আর বাজেটে মোট রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৩ লাখ ৩৯ হাজার ২৮০ কোটি টাকা। কর-বহির্ভূত খাত থেকে রাজস্ব আদায় ধরা হয়েছে ৩৩ হাজার ৩৫২ কোটি টাকা। যা জিডিপি’র ১.৩ শতাংশ। এনবিআরের জন্য তার নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রা অর্জন অন্যতম বড় চ্যালেঞ্জ। বিশেষজ্ঞদের মতে এনবিআরের বর্তমান কাঠামোতে এই লক্ষ্যমাত্রা পূরণ অসম্ভব। তবে এনবিআর চেয়ারম্যান দাবি করেছেন চ্যালেঞ্জ হলেও অসম্ভব নয়।

২০১৭-২০১৮ অর্থবছরে সংশোধিত ২ লাখ ২৫ হাজার কোটি টাকা লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে আদায় হয়েছে ২ লাখ ৫ হাজার ৯০৩ কোটি টাকা। যা বাজেট ঘোষণার সময় ২ লাখ ৪৮ হাজার ১৯০ কোটি টাকার রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্য দেওয়া হয়েছিল। যদিও এর আগে ২০১৪-২০১৫, ২০১৫-২০১৬ এবং ২০১৬-২০১৭ অর্থবছরে লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে সক্ষম হয়েছিল সংস্থাটি। ২০১৬-১৭ অর্থবছরে সংশোধিত লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ৩ কোটি টাকা, ২০১৫-১৬ অর্থবছরে লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ৪ হাজার ৭৮৩ কোটি ৯৩ লাখ টাকা এবং ২০১৪-১৫ অর্থবছরে প্রায় ২ হাজার কোটি টাকা বেশি রাজস্ব আদায় করেছিল এনবিআর।

ভ্যাট নিবন্ধন দেড় লাখ ছাড়িয়ে: মূল্য সংযোজন কর (মূসক) বা ভ্যাট আইন-২০১২ দুই বছরের জন্য স্থগিত হলেও থেমে নেই অনলাইন ভ্যাট নিবন্ধনের কাজ। অনলাইনে ভ্যাট নিবন্ধন এরই মধ্যে দেড় লাখ ছাড়িয়েছে। অনলাইনে ইলেকট্রনিক বিজনেস আইডেনটিফিকেশন নম্বর বা ই-বিআইএন নিতে পারছেন ব্যবসায়ীরা। অনলাইনে নিবন্ধন প্রক্রিয়া চালু হওয়ার দেড় বছরের বেশি পেরিয়ে অনলাইনে ভ্যাট নিবন্ধিতদের সংখ্যা দেড় লাখ ছাড়ানোয় খুশি এনবিআর। অনলাইনে সেবা নেওয়ার জন্য ভ্যাট নিবন্ধন বা ই-বিআইএন নেওয়ার বিষয়টি অনেকটা অনলাইনে কর শনাক্তকরণ নম্বর বা ই-টিআইএনের মতো। এর মাধ্যমে ঘরে বসেই ব্যবসায়ীরা ভ্যাট নিবন্ধন নিতে পারছেন। এরই মধ্যে যেসব প্রতিষ্ঠানের সনাতন পদ্ধতিতে নিবন্ধন নেওয়া আছে, সেসব প্রতিষ্ঠানকেও এখন নতুন করে অনলাইনে পুনঃনিবন্ধন নিতে হবে। বার্ষিক লেনদেন ৩০ লাখ টাকার বেশি হলেই কেবল এই নিবন্ধন নিতে হবে।

রেকর্ড আদায়ের আয়কর মেলা: ‘আয়কর প্রবৃদ্ধির মাধ্যমে সামাজিক ন্যায়বিচার ও ধারাবাহিক উন্নয়ন নিশ্চিতকরণ’ প্রতিপাদ্যে সফল পরিসমাপ্তি হয় আয়কর মেলা ২০১৮-এর। সপ্তাহব্যাপী আয়কর মেলায় মোট আয়কর আদায় হয় ২ হাজার ৪৬৮ কোটি ৯৪ লাখ ৪০ হাজার ৮৯৫ টাকা। যা ২০১৭ সালের আয়কর মেলার তুলনায় ২৫১ কোটি ৬১ লাখ ২৬ হাজার ৬৭৪ টাকা বেশি। প্রবৃদ্ধি ১১.৩৫ শতাংশ। ২০১৭ সালে আয়কর মেলায় আদায় হয়েছিল ২ হাজার ২১৭ কোটি ৩৩ লাখ ১৪ হাজার ২২১ টাকা। আয়কর মেলায় সেবা নেন ১৬ লাখ ৩৬ হাজার ২৬৬ জন। রিটার্ন দাখিল করেন ৪ লাখ ৮৭ হাজার ৫৭৩ জন। ই-টিআইএন নেন ৩৯ হাজার ৭৪৩ জন।  এবারে ঢাকাসহ সকল বিভাগীয় শহরে সাত দিন, ৫৬টি জেলা শহরে চার দিন, ৩২টি উপজেলায় দুই দিন এবং ৭০টি উপজেলায় এক দিনব্যাপী মেলা হয়। মেলার পরপরই কর অফিসে ১০দিনব্যাপী ছিল মেলার পরিবেশে রিটার্ন দাখিলের সুযোগ।

স্বর্ণ নীতিমালা: অনেক চড়াই-উতরাই পেরিয়ে অবশেষে চূড়ান্ত হয়েছে স্বর্ণ নীতিমালা-২০১৮। বাংলাদেশ ব্যাংকের তদারকিতে দেশের অনুমোদিত ডিলার (এডি) দুই বাণিজ্যিক ব্যাংকের মাধ্যমে আমদানি হবে ব্যবসায়ীদের চাহিদাকৃত সোনা বা স্বর্ণবার। যা দেশের মূল্য সংযোজন কর (ভ্যাট/মূসক) নিবন্ধিতসহ আরো কিছু শর্তসাপেক্ষে প্রকৃত স্বর্ণালংকার প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান, ব্যবসায়ী ও ডিলার আমদানি করতে পারবে প্রয়োজনীয় সোনা। অন্তত ১৫ দিন আগে চাহিদাপত্র দাখিল ও মোট মূল্যের ৫ শতাংশ জামানত দিয়ে মিলবে কাঙ্ক্ষিত সুযোগ। এছাড়া রপ্তানিতে বন্ড সুবিধাসহ বিশেষ প্রণোদনা কিংবা ভোক্তার অধিকার সংরক্ষণসহ আটটি অনুচ্ছেদ, ৫৮টি উপ-অনুচ্ছেদ আছে ওই নীতিমালায়। স্বর্ণ চোরাচালান রোধ এবং স্বর্ণ আমদানিতে স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে ‘স্বর্ণ নীতিমালা-২০১৮’ এর খসড়ায় গত ৩ অক্টোবর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত মন্ত্রিসভা বৈঠকে নীতিগত অনুমোদন দেওয়া হয়। গত ২৩ মে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতের সভাপতিত্বে অর্থনৈতিক বিষয় সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটির বৈঠকে নীতিগত অনুমোদন দেওয়া হয়। নভেস্বর স্বর্ণ শিল্পে অধিকতর স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে ও স্বর্ণ চোরাচালান প্রতিরোধে ‘স্বর্ণ নীতিমালা-২০১৮’ বাস্তবায়নে উচ্চ পর্যায়ের একটি কমিটি গঠন করা হয়। যার মাধ্যমে বাস্তবায়নের কাজ এগিয়ে চলছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের ভল্টের সোনা নিয়ে হইচই:  শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তর কর্তৃক বাংলাদেশ ব্যাংকের ভল্টে রাখা ৯৬৩ কেজি সোনা পরীক্ষায় অনিয়মের বিষয়টি নিয়ে বছরের মধ্যভাগে উত্তপ্ত হতে দেখা গেছে। এনবিআর এ বিষয়ে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য বাংলাদেশ ব্যাংককে অনুরোধ করে। এনবিআরের প্রতিবেদন অনুযায়ী ২০১৫ সালের ২৩ আগস্ট কাস্টম হাউসের গুদাম কর্মকর্তা হারুনুর রশিদ গোলাকার কালো প্রলেপযুক্ত একটি সোনার চাকতি এবং একটি কালো প্রলেপযুক্ত সোনার রিং বাংলাদেশ ব্যাংকে জমা দেন। বাংলাদেশ ব্যাংক ওই চাকতি এবং আংটি যথাযথ ব্যক্তি দিয়ে পরীক্ষা করে ৮০ শতাংশ (১৯ দশমিক ২ ক্যারেট) বিশুদ্ধ সোনা হিসেবে গ্রহণ করে প্রত্যয়নপত্র দেয়। কিন্তু দুই বছর পর পরিদর্শক দল ওই চাকতি ও আংটি পরীক্ষা করে তাতে ৪৬ দশমিক ৬৬ শতাংশ (১১ দশমিক ২ ক্যারেট) সোনা পায়।

আংটিতে পায় ১৫ দশমিক ১২ শতাংশ সোনা (৩ দশমিক ৬৩ ক্যারেট)। এতে সরকারের ১ কোটি ১১ লাখ ৮৭ হাজার ৮৬ টাকা ৫০ পয়সা ক্ষতি হয়েছে দাবি করা হয়। বিষয়েটি নিয়ে ব্যাপক সমালোচনার পরে বাংলাদেশ ব্যাংক সংবাদ সম্মেলন করে দাবি করে ভল্টে রক্ষিত সোনায় কোনো ধরনের হেরফের হয়নি। স্বর্ণকারের ভুলে ভাষার গণ্ডগোলে ৪০ হয়ে গেছে 'এইটটি'। ত্রুটি বলতে যা আছে, নথিভুক্ত করার সময় ইংরেজি-বাংলার ভুল। এর বাইরে অন্য ত্রুটি বাংলাদেশ ব্যাংকের নেই। শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তর যেভাবে ভল্টে সোনা রেখেছিল, তা সেভাবেই রয়েছে।



রাইজিংবিডি/ঢাকা/২৩ ডিসেম্বর ২০১৮/এম এ রহমান/শাহনেওয়াজ

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়