ঢাকা     শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৭ ১৪৩১

ফেসবুকের এ দুর্দশা কেন?

নিয়ন রহমান || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৪:০০, ১০ এপ্রিল ২০১৮   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
ফেসবুকের এ দুর্দশা কেন?

মার্ক জাকারবার্গ

নিয়ন রহমান : ব্যক্তিগত তথ্যের অপব্যবহার কেলেঙ্কারিতে মার্কিন কংগ্রেসের মুখোমুখি করা হচ্ছে ফেসবুক প্রতিষ্ঠাতা মার্ক জাকারবার্গকে। তিনি সরাসরি ক্ষমা প্রার্থনা করবেন কিন্তু তার কোম্পানি এখনো জানে না এই পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় তার হারানো গৌরব কীভাবে ফিরিয়ে আনবে।

একবার ভেবে দেখুন তো কেমন লাগে? ইউনাইটেড স্টেটস ৩২৭ মিলিয়ন মানুষের একটা রাষ্ট্র এবং এই রাষ্ট্রের ক্ষমতায় আছেন নিজের প্রশংসায় পঞ্চমুখ ও মানসিকভাবে অপরিপক্ক একজন ৭১ বছরের শ্বেতাঙ্গ বৃদ্ধ। আর এই রাষ্ট্রের আইন প্রণয়নকারীগণ এমন একজনকে আইনের সামনে এনে দাঁড় করাতে চাচ্ছেন, যিনি কি না মার্ক জাকারবার্গ। ২.২ বিলিয়ন মানুষ সহ একটি ভার্চুয়াল দুনিয়ার একচ্ছত্র অধিপতি। তার বিরুদ্ধে এই রাষ্ট্রের অভিযোগ হলো, তিনি অনিচ্ছাকৃতভাবে হলেও অবৈধভাবে অপরিপক্ক একজন রাষ্ট্রপতির নির্বাচনে জয়লাভ সহজ করে দিয়েছেন। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ, নির্বাচনের সময় রাশিয়ান এজেন্ট ও অন্যান্য কুচক্রী দল জাকারবার্গের এই ভার্চুয়াল দুনিয়ায় অবৈধভাবে নজরদারি করেছিল।

এই ধরনের উটকো ঝামেলার মধ্যে ফেসবুক কীভাবে পড়ল? এই প্রশ্নের উত্তর জানতে হলে আগে বুঝতে হবে ডিজিটাল টেকনোলজির অদ্ভুত গতিবিধি সম্পর্কে। আরো জানতে হবে সিলিকন ভ্যালি তত্ত্ব, মার্ক জাকারবার্গের রাজনৈতিক অনাগ্রহতা, সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের নৈতিকতা এবং সর্বপরি বর্তমান পুঁজিবাদী নজরদারিতা সম্পর্কে।

মূল ব্যাপার ছিল যেকোনো বিষয়ে সুযোগ-সুবিধা প্রদানে ডিজিটাল নেটওয়ার্কের একচেটিয়া ক্ষমতা। ফেসবুক হলো একটি ব্যক্তিগত প্লাটফর্ম যেটা তৈরি করা হয়েছিল এক সর্বজনীন প্লাটফর্ম ‘ওয়ার্ড ওয়াইড ওয়েব’ এর মধ্যে। যেই ‘ওয়ার্ড ওয়াইড ওয়েব’ আবার এমন এক ব্যবস্থার মধ্যে তৈরি করা হয়েছে যেটার অর্থনৈতিক যোগান ছিল আয়কর প্রদানকারীদের ‘কর’ থেকে।

মার্ক জাকারবার্গ একটা সফটওয়্যার অ্যাপ্লিকেশনের মতো করে তৈরি করেছিলেন, যার মাধ্যমে একজন ব্যক্তি আরেকজন ব্যক্তির সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারে ও ব্যক্তিগত তথ্যাদি আদান-প্রদান করতে পারে। এমন একটি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহার ছিল সম্পূর্ণ ফ্রি আর তাই এটা দাবানলের মতো চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে এবং চলে যায় জনপ্রিয়তার তুঙ্গে।

যদিও এটাই সর্বপ্রথম সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম ছিল না। ‘মাইস্পেস’ এর মতো আরো অন্যান্য কিছু সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের আদলে তৈরি করা হয়েছিল এই ফেসবুক। যার জনপ্রিয়তার স্রোতে টিকতে না পেরে হারিয়ে যায় তৎকালীন আরো কিছু জনপ্রিয় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম।

ফেসবুক যত জনপ্রিয় হচ্ছিল ততই এর অন্যান্য প্রতিক্রিয়াও প্রকাশ পাচ্ছিল। যেমন একজন কিশোর যদি দৈহিক মিলনের সঙ্গী খুঁজতে চায় তবে তার শুধু একটা ফেসবুক অ্যাকাউন্ট থাকলেই হয়ে যাবে। আরো বিভিন্ন কারণে ধীরে ধীরে ফেসবুকের জনপ্রিয়তা চরম সীমায় পৌঁছে যায়।

একদম শুরুর দিকে ফেসবুক ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানের চিন্তা ভাবনায় ছিল না। কিন্তু যদিও ফেসবুক সম্পূর্ণ ফ্রি তবুও এটা চালাতে প্রচুর অর্থের প্রয়োজন পরে এই প্রতিষ্ঠানের। যেহেতু এটা সবচাইতে জনপ্রিয় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম তাই সার্চ ইঞ্জিন গুগলের মতোই পরবর্তীতে ফেসবুক একটি বিজ্ঞাপন প্রতিষ্ঠান হয়ে দাঁড়ায়।

ফেসবুক ব্যবহারকারীরা নিজেদের অজান্তেই ফেসবুক ব্যবহার করতে যেয়ে নিজেদের ব্যক্তিগত অনেক তথ্য ফেসবুকের কাছে দিয়ে দিচ্ছিল। যেমন, একজন মানুষ কী পছন্দ করে, কী অপছন্দ করে, কোন ধরনের খাবার খায়। কোন স্কুলে পড়াশুনা করেছে, কোথায় থাকে ইত্যাদি ইত্যাদি। এসব তথ্য কাজে লাগিয়ে ফেসবুক বিজ্ঞাপন দাতাদের থেকে অর্থের বিনিময়ে তাদের বিজ্ঞাপন সঠিক মানুষের কাছে পৌঁছে দিতে থাকে।

এভাবে ফেসবুক একটি পুঁজিবাদী প্রতিষ্ঠান হয়ে যায়। ভোক্তাদের থেকে প্রাপ্ত তথ্য কাজে লাগিয়ে নিজেদের অর্থনৈতিক উন্নতি সাধন আর কী! ভোক্তা যত বেশি সময় ফেসবুকে কাটায় তত বেশি তথ্য সে ফেসবুককে দিতে থাকে। এবং এই বিজ্ঞাপন প্রদান করেই ফেসবুক পৃথিবীর ষষ্ঠ দামী প্রতিষ্ঠান হয়ে দাঁড়ায়।

ফেসবুক একটা অটো সিস্টেম তৈরি করে নেয় যার মাধ্যমে বিজ্ঞাপন সঠিক মানুষের কাছে পৌঁছে যাবে। কিন্তু ফেসবুক কখনো ভাবতেও পারেনি তাদের এই সিস্টেম সঠিক সময়ে সঠিক মানুষের কাছে রাজনৈতিক বক্তব্যও প্রচার করা সম্ভব। যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচনের সময়ে ঠিক এমনই একটা অবস্থার মুখোমুখি হয়েছিল ফেসবুক।

গত সপ্তাহে ফেসবুকের প্রতিষ্ঠাতা এটা স্বীকার করেন যে, তারা কখনো ভাবতে পারেননি যে এভাবে কেউ কারো ক্ষতি সাধনেও সিস্টেম কাজে লাগিয়ে ভুল তথ্য দিয়েও বিজ্ঞাপন দিতে পারে। তিনি আরো বলেন যে, এটা তাদের একটা বড় ভুল ছিল। ৮৭ মিলিয়ন মানুষের তথ্য এই নির্বাচনের সময় কাজে লাগানো হয়েছিল।

ফেসবুক যে সিস্টেমকে কাজে লাগিয়ে এত বড় একটা কোম্পানি হয় সেই সিস্টেমটাই বর্তমানে তাদের জনপ্রিয়তা হ্রাসের মূল কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই জনপ্রিয়তা হ্রাস থেকে কত দ্রুত ফেসবুক বের হতে পারে সেটা এখন দেখার বিষয়।

তথ্যসূত্র : দ্য গার্ডিয়ান

পড়ুন : 



রাইজিংবিডি/ঢাকা/১০ এপ্রিল ২০১৮/ফিরোজ

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়