ঢাকা     শুক্রবার   ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৬ ১৪৩১

দ্য সোর্ড অব টিপু সুলতান

ফেরদৌস জামান || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৮:০৭, ৩০ ডিসেম্বর ২০১৬   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
দ্য সোর্ড অব টিপু সুলতান

ফেরদৌস জামান : ‘দ্য সোর্ড অব টিপু সুলতান’র কথা মনে আছে? কাহিনি মনে না থাকলেও যতদূর মনে পড়ে একটি পর্বও দেখা বাদ দেইনি। বাংলাদেশ টেলিভিশনের সাড়া জাগানো ইন্ডিয়ান এই ধারাবাহিক প্রচার হতো সপ্তাহের নির্দিষ্ট একটি দিন রাত নয়টায়। গ্রামে একটি মাত্র রঙ্গিন টিভি হওয়ায় আশপাশের সকলেই ছুটে আসত আমাদের বাড়ি। প্রচণ্ড আগ্রহ নিয়ে বসে থাকত কিন্তু নির্দিষ্ট সময়ে কোনো দিনই শুরু হতো না এক বেসরকারী ব্যাংকের বিরক্তিকর বিজ্ঞাপনের কারণে। পর্ব শেষ হলেও সকলের মুখে মুখে তার রেশ থেকে যেত আরও কিছুক্ষণ। অবশেষে সপ্তাহ ঘুরে পরবর্তী পর্বের দিন কবে ফিরে আসবে সেই প্রতীক্ষা মেনে নিয়ে সবাই ফিরে যেত যে যার বাড়ি।

 

ধারাবাহিকটিতে আমরা দেখেছি টিপু সুলতানের সৌর্য-বীর্য এবং প্রাসাদ ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে ইংরেজ দ্বারা তাকে ধরাশায়ী হতে। কার্যত ১৭৯৯ সালের ৪ মে মহীশূর জয় করার মধ্য দিয়েই ইংরেজ ঔপনিবেশিক শক্তি ভারতবর্ষের একচ্ছত্র অধিপতি হিসেবে অধিষ্ঠিত হয়। ব্যাঙ্গালুরু গিয়ে সর্বপ্রথম যে জায়গাটি ভ্রমণ করার ইচ্ছা ছিল তা হলো, টিপু সুলতানের স্মৃতিবজড়িত মহীশূর। ঘোরাঘুরির পরিমাণ এতটাই বেড়ে গেল যে, মাস শেষে নিজের থাকা-খাওয়ার হিসাবে টান পড়ে যাওয়ার উপক্রম। এবার কিছু দিনের বিরতি দিয়ে প্রস্তুত হতে থাকলাম টিপু সুলতানের জন্মস্থান এবং তার সেই দূর্গ দেখার জন্য।

 

আমার স্কুলের বন্ধু রিংকুর বাসায় চলছে পরিকল্পনা, সে নিজেও রাজাজী নগরের থাকে। কীভাবে যাওয়া যায়? প্রথমে চিন্তা করা হলো মোটর সাইকেল নিয়ে পারি দিলে কেমন হয়? তারপর ভেবে দেখা গেল, মোটর সাইকেল নিয়ে গেলে এমন কিছু জায়গা আছে যেখানে নির্ঘাত বিপত্তি হতে পারে। তাছাড়া, দলে সদস্যের সংখ্যা দিনকে দিন বেড়ে গিয়ে ঠেকল আটে। অথচ, প্রথম যখন উদ্যোগ নেওয়া হয় তখন কারও পক্ষ থেকেই তেমন সাড়া মেলেনি। সুতরাং সব শেষে সিদ্ধান্ত হয়, গতানুগতিকভাবেই যাওয়া হবে। চাঁদপুরের আনসার এবং আসাম গৌহাটির নির্মলের একযোগে অসুস্থতার কারণে ভ্রমন পরিকল্পনা পেছাতে হলো এক সপ্তাহ। তার আগেও ব্যাঙ্গালুরু আরটি নগরের ননিত কানাড়ির অসুস্থতার জন্য প্রথম দফা ট্যুর পেছানো হয়েছিল। এবার সিদ্ধান্ত হলো নির্ধারিত তারিখেই রওনা দেব। যারা অসুস্থ বা ব্যস্ত তাদের জন্য আর কোনো তারিখ পরিবর্তন নয়!

 

 

এপ্রিল মাসের এক সকালে গিয়ে পৌঁছলাম টিপু সুলতানের জন্মস্থান দেওয়ানহাল্লিতে। ১৭৫১ সালে তিনি এখানেই জন্মগ্রহণ করেন। তার জন্মস্থান পরম যত্নে আজও চিহ্নিত রয়েছে। খোদাই করা একটি প্রস্তর খণ্ডে সুন্দর করে লেখা- বার্থ প্লেস অব টিপু সুলতান। পিতা হায়দার আলীর মৃত্যুর পর তিনি মহীশূরের সুলতান হিসেবে সিংহাসনে বসেন। তার রাজ্যের বিস্তৃতি ছিল উত্তরে কৃষ্ণ নাদী, পূর্বে পূর্ব ঘাট এবং পশ্চিমে আরব সাগর পর্যন্ত।

 

দূর্গ প্রাচীর ও তার আশপাশের পরিবেশ দেখে সহজেই অনুমান করা যায়, শাসক হিসেবে টিপু সুলতান কতটা পরাক্রমশালী ছিলেন। বড় বড় পাথর খণ্ডে নির্মিত দূর্গ প্রাচীর। সংরক্ষিত অংশগুলি দেখে অনুমান করা যায়, কী সুনিপূণ ছিল তার নির্মাণশৈলী। যথাযথ কর্তৃপক্ষের বিশেষ নজরদারী ও তদারকীতে সম্পূর্ণ দূর্গ এলাকা বর্তমানে পর্যটকদের জন্য বিশেষভাবে সাজানো। প্রাচীরগুলোর আশপাশ দিয়ে লাগানো মিহি ঘাসের পড়ত দেখে মনে হবে সবুজ কার্পেট বিছানো। মাঝ দিয়ে বয়ে যাওয়া খাল সংস্কার করে তাতেও দেওয়া হয়েছে নান্দনিকতার ছোঁয়া। প্রতি দিন হাজার হাজার দর্শনার্থী দূর্গ ভ্রমণ করেন।

 

যুক্ত হয়ে যাই এক স্কুল থেকে ঘুরতে আসা শিক্ষার্থীদের সঙ্গে। গোল হয়ে বসে শিক্ষকের কাছ থেকে তারা শুনছিল টিপু সুলতানের ইতিহাস। পিতার মৃত্যুর পর তিনি যখন সিংহাসনে বসলেন তখন পুরনো সিংহাসন তার পছন্দ হলো না। তাই তিনি তৎকালীন শ্রেষ্ঠ কারিগর দিয়ে কাঠের কাঠামোতে সোনার পাত বসিয়ে মণি-মুক্তাখচিত একটি সিংহাসন বানিয়ে নিলেন। আট কোণা আসনটির ঠিক মাঝখানে ছিল একটি বাঘের মূর্তি। আট ফুট চওড়া আসনের দুই রেলিং-এর মাথায় বসানো ছিল সম্পূর্ণ স্বর্ণের তৈরি দুটি বাঘের মাথা। তার রাজ্যের প্রতীকই ছিল বাঘ। বাঘ ছিল তার অনুপ্রেরণার। রাজ্যের পতাকায় পর্যন্ত কানাড়ী ভাষায় লেখা ছিল ‘বাঘই ঈশ্বর’। সিংহাসনে বসে মাঝে মাঝে নাকি তিনি বলতেন, শিয়ালের মতো দুইশ বছর বাঁচার চেয়ে বাঘের মতো দুদিন বেঁচে থাকাও উত্তম। তার পোষাকও ছিল বাঘের শরীরের মতো হলুদের উপর কালো ডোরা কাটা নকশার। তিনি যে তলোয়ার ব্যবহার করতেন তার হাতলেও ছিল খোদাই করা বাঘের মূর্তি।

 

 

আমাদের দলের আনসার মৃধা এতক্ষণ বেশ চুপচাপ ছিল। স্যারের কথা শুনতে শুনতে হাত তুলে সে কিছু বলতে চাইল। অমনি সবার দৃষ্টি ঘুরে গেল তার দিকে। স্যার জানতে চাইলেন তার জিজ্ঞাসা। সে বলল, টিপু সুলতানের ব্যাঘ্র প্রীতির কারণটা কী হতে পারে?

 

এবার স্যার পুনরায় শুরু করলেন, ‘টিপু কানাড়ী শব্দ, যার বাংলা অর্থ বাঘ বা শের। সুতরাং, কেউ কেউ ধারণা করে, এখান থেকেই তার নাম রাখা হয়েছে টিপু। কিন্তু ইতিহাস থেকে জানা যায়, পিতা হায়দার আলী ও মাতা ফখরুন্নেসার ঔরসে অনেক দিন হয়ে যায় কোনো সন্তান ছিল না। এমন পরিস্থিতিতে টিপু নামক এক ফকির-দরবেশের দোয়ায় ফখরুন্নেসা গর্ভবতী হন। আর সে কারণেই দরবেশের নামানুসারে সন্তানের নাম রাখা হয় টিপু সুলতান। তাছাড়া, ছোট বেলা থেকেই টিপু বাঘের গল্প শুনতে ভালোবাসতেন। মূলত পিতা হায়দার আলীই তাকে বাঘের গল্প শোনাতেন। এক পর্যায়ে তিনি কিশোর বয়সে বাঘ পালতে শুরু করেন। বাঘের প্রতি তার দূর্বলতা এতটাই অধিক ছিল যে, রাজ্যের সৈনিকদের পোষাকেও থাকত বাঘের ছবি।

 

সৈনিকদের ব্যবহৃত তলোয়ার, তীর, বল্লম ইত্যাদিতে থাকত বাঘের প্রতিকৃতি। এমনকি তিনি তার রাজ্যের প্রধান প্রধান সড়কের পাশের বাড়িগুলোতে বাঘের ছবি আঁকার নির্দেশ জারি করেছিলেন। শাসক হওয়ার পরও তার বাঘ পোষার বাতিক যায়নি, প্রাসাদে বেশ কয়েকটি পোষা বাঘ ছিল। এর মধ্যে কয়েকটি আবার তার ঘরের দরজার সামনে বাঁধা থাকত। ইংরেজদের বিরুদ্ধে দ্বিতীয় মহীশূর যুদ্ধে টিপু সুলতানের পিতা মারাত্মকভাবে আহত হন এবং মহীশূরের ব্যাপক ক্ষয়-ক্ষতি হয়। যুদ্ধে ইংরেজ পক্ষের নেতৃত্বে ছিল হেক্টর মুনরো। সঙ্গত কারণেই তিনি ইংরেজদের এতটাই শত্রুজ্ঞান করতেন। হেক্টর মুনরোর ছেলে একবার এক দ্বীপে বাঘ শিকার করতে গিয়ে বাঘের আক্রমণে প্রাণ হারান। এই সংবাদ পেয়ে টিপু সুলতান তৎকালীন ফরাসী যন্ত্রকুশলীদের দ্বারা একটি খেলনা বানিয়ে নেন, দম দিয়ে ছেড়ে দিলে রক্ত হীম করা গর্জন এবং একইসঙ্গে ইংরেজদের  গোঙ্গানীর শব্দ শোনা যেত। খেলনাটি ছিল বাঘ একজন ইংরেজকে আক্রমণ করেছে, ইংরেজটি প্রাণ বাঁচাতে আপ্রাণ চেষ্টা করছে। মাঝে মাঝে নাকি টিপু সুলতান গভীর রাতে এই যন্ত্রের শব্দ শুনে সময় পার করতেন। যদিও টিপু সুলতানকে শের-ই-মহীশূর উপাধি ইংরেজদেরই দেওয়া। 

 

 

স্যারের কথা শুনতে শুনতে শিক্ষা সফরে আসা স্কুল শিক্ষার্থীদের সাথে আমরাও জুড়ে গেলাম এবং বাকি সময় তাদের সাথেই কেটে গেল। দেখা বাকি রয়েছে টিপু সুলতানের মৃত্যুস্থান। অর্থাৎ যে জায়গায় তাকে ষড়যন্ত্রকারী মীর সাদিক ও অন্যান্যদের সহযোগিতায় নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছিল। লাইন ধরে একে একে পৌঁছে যাই সেই বিশেষ জায়গাটিতে। এখানেও একটি প্রস্তর খণ্ড স্থাপন করা রয়েছে, ধূসর পাথরের গায়ে খোদাই করা ইংরেজি বর্ণে লেখা- দ্য বডি অব টিপু সুলতান ওয়াজ ফাউন্ড হেয়ার।

 

ফলকটি দেখার পর চোখের সামনে যেন দ্য সোর্ড অব টিপু সুলতান-এর শেষ দৃশ্যটি ভেসে উঠল। দূর্গের কাঠের শক্ত দরজা ভেঙ্গে লাল পোষাক পরিহিত ইংরেজ বাহিনী প্রবেশ করছে আর তলোয়ার দিয়ে প্রবল প্রতিরোধ করে যাচ্ছেন শের-ই-মহীশূর টিপু সুলতান। দূর থেকে হঠাৎ একটি বুলেট এসে বিধল তার বুকে। তবুও টিপুর তলোয়ার চলছে বীরবিক্রমে। কণ্ঠ দিয়ে বেরিয়ে আসছে বাঘের গর্জন।

 

 

রাইজিংবিডি/ঢাকা/৩০ ডিসেম্বর ২০১৬/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়