ঢাকা     মঙ্গলবার   ২৩ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১০ ১৪৩১

সোনায় মোড়ানো সাঁচি

কাজী আশরাফ || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১১:৪৬, ৯ মে ২০১৭   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
সোনায় মোড়ানো সাঁচি

কাজী আশরাফ : গাড়ি ছুটছে ভুপাল ছাড়িয়ে উত্তর দিকে। ফেব্রুয়ারি মাসের মেঘহীন দুপুর। রাস্তার দু’পাশে কখনও সবুজ শস্যের স্নিগ্ধতা আবার কখনও মধ্যপ্রদেশের চিরায়ত রুদ্র রূপ। মাইলের পর মাইল কোন পাহাড় বা টিলার দেখা নেই। গাড়ি চলছে তার আপন মনে। গন্তব্য পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ বৌদ্ধ শিল্প নিদর্শনের শহর সাঁচি। হঠাৎ চোখে পড়ে হুট করে সমতল থেকে উঠে আসা টিলার ওপর সাঁচির বিশ্ববিখ্যাত স্তূপ। বইতে দেখা এ নিদর্শনগুলো এভাবেই চোখের সামনে এসে দাঁড়ায় সাঁচিতে। পুরো মধ্য প্রদেশটিই এমন। রুদ্র-রুক্ষ এ অসাধারণ রাজ্যেই পৃথিবীর ৩টি ‘ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট’। এগুলো হচ্ছে খাজুরাহো, ভীমবৈঠকা এবং সাঁচি। প্রত্মতত্ত্বের এক অপরূপ খনি এ সাঁচি। তাই সাঁচিতে ঘুরেফিরে চলে আসবে প্রত্মতত্ত্বের কথা।

এক কথায় সাঁচি পৃথিবীর অন্যতম বৌদ্ধ স্থাপত্যের নিদর্শনের শহর। অথচ মজার ব্যাপার হলো সাঁচির সঙ্গে স্বয়ং বুদ্ধদেবের কোন প্রত্যক্ষ যোগাযোগ হয়নি কখনও। গৌতম বুদ্ধ কখনও সাঁচিতে আসেননি। যিনি বৌদ্ধ ধর্মের প্রবক্তা হিসেবে এ অঞ্চলে কাজ করেছেন তিনি স্বনামখ্যাত সম্রাট অশোক। অশোকের স্ত্রী দেবী ছিলেন সম্রাজ্ঞী বিদিশার মেয়ে। সাঁচির এসব পাহাড় তখন ‘বিদিশাগিরি’ নামে পরিচিত ছিল।

 



সম্রাট অশোকই বিদিশাগিরি অর্থাৎ সাঁচিতে স্তূপ স্তম্ভ এবং মঠ স্থাপন করেন। অশোক কন্যা সঙ্ঘমিত্রা এবং ছেলে মহেন্দ্র শ্রীলঙ্কায় বৌদ্ধধর্ম প্রচার করতে যাওয়ার আগে সাঁচিতে আসেন মা দেবীর সঙ্গে দেখা করতে। দেবী তার পুত্র-কন্যাকে নিয়ে সেখানকার বৌদ্ধ মঠ প্রদর্শনে আসেন। সেই ঐতিহাসিক মঠের ভগ্নাংশ এখনও দেখতে পাওয়া যায় এক নম্বর স্তূপের পূর্বদিকে। বিশাল এলাকাজুড়ে এ মঠ। তাতে অনেক ঘর, রয়েছে উপাসনা মন্দির। মঠের পাশে রাখা আছে বিশাল এক পাথরের পাত্র। সেই পাত্রেই সব দান সামগ্রী জমা হতো। পরে সেই দান গরিবদের মধ্যে বিতরণ করা হতো। এসব ঘটনা যিশুর জন্মেরও তিনশ বছর আগে। এরপর থেকে টানা ১৫০০ বছর ধরে সাঁচিতে বৌদ্ধ শিল্পের এবং স্থাপত্যের ভাঙাগড়ার কাজ চলেছে। সৃষ্টির বিভিন্ন শ্রেণী আছে কিন্তু শ্রেষ্ঠত্বের মান একটাই। তার মুখোমুখি হলে বাকি সব নগণ্য হয়ে যায়। সাঁচির এক নম্বর স্তূপের সামনে দাঁড়িয়ে অন্তত তাই মনে হয়। মঠের আগে উত্তরমুখী তোরণের অসাধারণ সেসব কারুকাজ দেখলে আর কিছুই মনে থাকে না তখন। চোখ এবং মন দুটো জুড়েই থাকে কেবলই শিল্পের নান্দনিক পরশ।

সম্রাট অশোক যে স্তূপ গড়েছিলেন তা কালের বিবর্তনে ঢাকা পড়ে গেছে এখনকার স্তূপের নিচে। আসল স্তূপটি অনেক ছোট ছিল। সম্রাট অশোকের স্তূপের ওপর তৈরি হয় আরও বড় স্তূপ। এরও ১০০ বছর পরে এ বড় স্তূপ ঘিরে তৈরি হয় অলিন্দ। মানুষের পায়ে পায়ে সেই অলিন্দের পাথরও ক্ষয়ে এসেছে। এর পর অলিন্দ ঘিরে তৈরি করা হয়েছে প্রদক্ষিণ পথ। আবারও ১০০ বছরের অপেক্ষা।

সাঁচির ১ নম্বর এবং ৩ নম্বর স্তূপের চারদিকে রয়েছে ৪টি তোরণ। তোরণের কারুকাজগুলো খুবই সূক্ষ্ম। এর রহস্য উদ্ধারের জন্য যেতে হবে হাতির দাঁতের শিল্পী, স্বর্ণকার এবং কাঠের সেসব সূক্ষ্ম শিল্পীদের কাছে যারা এ তোরণ নির্মাণ করেছেন। আর স্তূপের ব্যাখ্যা হলো ১ নম্বর স্তূপের মধ্যেই গৌতম বুদ্ধের দেহভস্ম রাখা আছে। ৩ নম্বর স্তূপে আছে বুদ্ধের শিষ্য সারীপুত্র এবং মহামোগ্গলানার ভস্ম। মজার ব্যাপার হলো, সাঁচি বৌদ্ধধর্মের পবিত্র জায়গা হলেও এখানে কোন বৌদ্ধ মূর্তি নেই। এর কারণ হলো, তখন পর্যন্ত বৌদ্ধ ধর্মে মূর্তিপূজা অনুমোদন পায়নি। আরেকটি কারণ হতে পারে বিদিশা অঞ্চলে কারুশিল্পী থাকলেও তেমন ভালো মূর্তি শিল্পী ছিল না। তাই পুরো সাঁচিতে স্তূপগুলোতে কখনও ধর্মচক্র, কখনও পদচিহ্ন আবার কখনও অশ্বত্থ বৃক্ষ এঁকে বুদ্ধির উপস্থিতি বোঝানো হয়েছে।

 



সে যাই হোক ১ নম্বর স্তূপের উত্তরমুখী তোরণ থেকে দক্ষিণ দিকে গেলে চোখে পরবে খুবই পুরনো দুটি মন্দির। দেখতে অনেকটা প্রাচীন গ্রিক কিংবা রোমান মন্দিরের মতো।

মৌর্যযুগ অবসানের পর সাঁচির স্তূপের ওপর ব্যাপক ধ্বংসাত্মক আক্রমণ হয়। অশোকের স্তূপ তো বটেই, সাঁচির সব সৌধই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল তখন। কিন্তু পরে স্থানীয় বৌদ্ধ ভিক্ষু এবং ব্যবসায়ীরা আবার সেগুলো মেরামত করিয়ে নেন। তৈরি হয় নতুন মঠ আর মন্দির। গৌতম বুদ্ধের বেশ কতগুলো মূর্তি তখন নিয়ে আসা হয় মথুরা থেকে। এসময় সতেরো নম্বর মন্দিরটি নির্মিত হয়। এভাবেই চলতে থাকে দুইশ বছর। এক সময় গুপ্ত সাম্রাজ্যের পতন ঘটে। ৬০০ খ্রিস্টাব্দে হর্ষবর্ধনের শাসনকালে বৌদ্ধধর্ম আরও একবার বিস্তার লাভ করে। এ অবস্থা চলে ১২০০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত।

তারপর একদিন সব বন্ধ হয়ে যায়। বৌদ্ধ সৌধের বদলে সাঁচিতে প্রতিষ্ঠা পায় হিন্দুফলক। তাতে বিষ্ণু, মহিষাসুরের আকৃতি। হঠাৎ যে কী হলো তা এখনও স্পষ্ট নয়। সাঁচি থেকে বৌদ্ধরা চলে যায় অন্যখানে, অন্য কেথাও। তারপর তারা আর ফিরে আসেনি। একি অভিমান না অস্তিত্ব রক্ষা তা এখনও অজানা। এরপর ৫০০ বছর কেটে গেছে। সাঁচির কথা মানুষ ভুলেই গিয়েছিল। কিংবা সাঁচিকে ভুলতে বাধ্য করা হয়েছিল। অনন্য সাধারণ ওইসব মন্দির স্তূপ আর মঠের ওপরে জমেছিল ধুলোর আবরণ। দূর থেকে বোঝার কোন উপায় ছিল না যে এখানে এত পুরাকীর্তি লুকিয়ে আছে। আছে অবহেলায়।

 



১৮১৮ সালে জেনারেল টেলার নামে এক ব্রিটিশ সেনানায়ক সাঁচির ভগ্নস্তূপ আবিষ্কার করেন। এতে উপকারের চাইতে অপকারই হয় বেশি। গুপ্তধনের আশায় নানা জায়গা থেকে নানা লোক এসে পুরাকীর্তির ওপর অকথ্য অত্যাচার চালাতে শুরু করে। ১৮২২ সালে ক্যাপ্টেন জনসন ভেতরে কী আছে দেখার জন্য এক নম্বর স্তূপটি ওপর থেকে নিচ পর্যন্ত কেটে ফেলে। প্রকাণ্ড একটা ফাটল তৈরি হয় তাতে। পশ্চিমের তোরণটা ভেঙে পড়ে। ২ নম্বর স্তূপ পুরোটাই ধ্বংস হয়ে যায়।

সাহেবদের এই ধ্বংসলীলার সঙ্গে হাত মেলায় স্থানীয় মানুষ। এ অঞ্চলেরই এক জমিদার অশোক স্তম্ভটি তিন টুকরো করে আখ মাড়াইয়ের কাজে ব্যবহার করতে বাড়ি নিয়ে যান। ১৮৮১ সালের আগে সাঁচি সংরক্ষণের কোন চেষ্টাই করা হয়নি।



রাইজিংবিডি/ঢাকা/৯ মে ২০১৭/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়