ঢাকা     বৃহস্পতিবার   ২৫ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১২ ১৪৩১

সাজেকের পথে পর্বতের প্রাচীর

ফেরদৌস জামান || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৭:১১, ২৫ মে ২০১৭   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
সাজেকের পথে পর্বতের প্রাচীর

(চর থেকে চিরসবুজের ডাকে: ষষ্ঠ কিস্তি)

ফেরদৌস জামান: ছয়-সাত বছর পূর্বে দেখা খাগড়াছড়ি আর আজকের খাগড়াছড়ির মধ্যে ঢের ফারাক। শহরে প্রবেশ করেই কেমন অচেনা মনে হলো। রং-ঢং বা দালান কোঠায় উল্লেখ করার মতো তেমন পরিবর্তন হয়নি, কেবল মানুষগুলো ছাড়া। কি বাঙালি কি পাহাড়ি- সবার আচরণেই ভিন্নতা। আগন্তুক দেখলে সাদরে গ্রহণ করার চিরায়ত রীতিতে কৃত্রিমতার ছোঁয়া। আচরণে সহযোগিতার চেয়ে কীভাবে সুযোগ নেওয়া যায় সেই মসসিকতা প্রতীয়মান। এ সব আন্দাজ করে নিতে খুব বেশি অপেক্ষা করতে হলো না। বিষয়টি একটু হতাশ করে দিলেও মেনে নেওয়াটাই শ্রেয়। কারণ জগতের সমস্ত কিছুই তো পরিবর্তনশীল, তা থেকে এখানকার মানুষগুলোই বা বাদ যাবে কোন দুঃখে?

আমাদের বেশ আর চলন দেখেই তারা বুঝে নিল সাজেকের পার্টি। একজন এগিয়ে এসে বলেই ফেলল, আপনারা সাজেকের পার্টি নাকি?

হ্যাঁ সূচক জবাব দিতেই সাগ্রহে বলল, আমার সাথে আসুন সব ব্যবস্থা করে দেব।

তা কী কী আছে আপনার সব ব্যবস্থার মধ্যে? প্রশ্ন করতেই জানা গেল, গাইড থেকে শুরু করে থাকা খাওয়া এবং যাওয়া আসার সমস্ত কিছু। পরিস্থিতি যে এমন হতে পারে তার কিঞ্চিৎ ধারণা আগে থেকেই পেয়েছিলাম। তবে এতটা পাবো বুঝতে পারিনি! তবুও যাচাই করার স্বার্থে জানতে চাইলাম, যাওয়া আসার কী ব্যবস্থা? বলল, চান্দের গাড়ি রিজার্ভ নিতে হবে। ভাড়া পড়বে বারো হাজার টাকা। ঠিক আছে আপনাদের জন্য দশ হাজার। বলতে সংকোচ নেই, বাঙালি হলে কষ্ট পেতাম না কিন্তু কষ্টের কারণ হলো লোকটি পাহাড়ি এবং গাড়ি চালক। একটি বিষয়ের উল্লেখ পূর্বেও একাধিক লেখায় করেছি, আজও করতে বাধ্য হচ্ছি- হঠাৎ ট্রাভেলার হয়ে ওঠা বাঙালি আমরা এতটাই পাগলপারা হয়ে গেলাম যে, টাকার বাক্স নিয়ে ট্রাভেল করতে যাই। আবেগে বেসামাল হয়ে অথবা চিরাচরিত স্বভাবের বশবর্তী হয়ে আগ-পিছ না ভেবে বাক্সের ঢাকনি খুলি আর ভ্রমণে গিয়ে বাইজির সামনে ছড়ানোর মতো নোট উড়িয়ে দেই। একবারও ভেবে দেখি না পরবর্তীতে যারা আসবে তাদের নিকট টাকার বাক্স নাও থাকতে পারে। আর একটি বিষয় তো আমাদের মধ্যে জাতিগতভাবেই রয়েছে- দরদাম করতে অস্বস্তি বোধ করি, যদিও রিকশা ভাড়া মেটানোর বেলায় মধ্যবিত্ত বাঙালি বেজায় সচেতন।

 


দুএকজন গাড়ি চালক বলল, রিজার্ভ গাড়ি ছাড়া নাকি যেতেই পারব না। সার্বিক পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণপূর্বক হতাশ হৃদয়ে হাঁটতে থাকলাম দিঘীনালা যাওয়ার স্ট্যান্ড পর্যন্ত। হাঁটছি আর ভাবছি, বিকল্প ব্যবস্থা বের করতেই হবে। স্ট্যান্ডে যেতেই দুই-তিনজন চালক এসে ঘিরে ধরল। ভিড়ের মধ্যে থেকে দেখি কয়েকজন যাত্রী নিয়ে একটি গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে। এগিয়ে গেলে যত্রীদের মাঝ থেকে একজন জানতে চাইল, দিঘীনালা যাব কিনা? সুযোগ পেয়ে তাড়াতাড়ি উঠে পরলাম। গাড়ি ছেড়ে দিল। পরিচয় হলো পাশে বসা শতদ্রুর সাথে। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই বন্ধুসহ তারা বাংলাদেশ প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের চারজন। এই ছয় বন্ধু রওনা হয়েছে সাজেকের উদ্দেশ্যে। সেমিস্টারের ফাঁকে একটি করে নতুন জায়গা ভ্রমণ করা প্রথমত তাদের অভ্যাস এবং দিনে দিনে তা নাকি বাড়ছে। বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি কোচিং করতে এসে তাদের পরস্পরের সাথে পরিচয় এবং পরবর্তীতে বন্ধুত্ব। দুইটি আলাদা বিশ্ববিদ্যালয়ে পাড়াশোনা করলেও সেই বন্ধুত্ব আজও অটুট। আমাদের মতো তারাও শঙ্কায় আছে আদৌ সাজেক যেতে পারবে তো? পরিচয় হয়ে ভালোই হলো। দল ভারি হলে সমস্যার সমাধান হয়েই যায়। এবার মিলেঝিলে যে কোনো উপায় বের করা যাবে। দিঘীনালা পৌঁছতেই চারপাশ থেকে চান্দের গাড়ি আর মোটর সাইকেল চালকরা ঘিরে ধরল। পরিকল্পনা করেছিলাম কৌশলে চুপি চুপি খোঁজখবর নেব, কীভাবে নির্বিঘ্নে যাওয়ার ব্যবস্থা করা যায়? সব ভেস্তে গেল পিঠের ব্যাগ-বোচকা আর নিজেদের ভাবভঙ্গির কারণে। আমাদের দুজনের ক্ষেত্রে দিঘীনালা নতুন নয়, একাধিকবার যাওয়া হয়েছে। কিন্তু ছয় বন্ধুর ক্ষেত্রে যা ঘটল তা হলো, উঁচুনিচু পাহাড়ি পথে খাগড়াছড়ি থেকে দিঘীনালা পৌঁছতেই আবেগ আর আনন্দে বিহ্বল। সব কিছু মিলে শিকারীদের চোখ এড়ানো গেল না। আমাদের নিয়ে একরকম টানাটানি শুরু হয়ে গেল। ভাড়া কম-বেশি চাওয়াকে কেন্দ্র করে গাড়ি চালকদের মধ্যে এক দফা কিল-ঘুষির ঘটনাও ঘটল। এক পর্যায়ে পুলিশের ভয় পর্যন্ত দেখাতে হলো। তাতে খানিকটা কাজ হলেও একলা বা এককভাবে কোনো চালকের সাথে কথা বলাটা কষ্টসাধ্য হয়ে পড়ল। কারও সাথে কথা বলতে শুরু করলেই চার-পাঁচজন এসে জড়ো হয়। এমন করে পেরিয়ে যায় প্রায় এক ঘণ্টা। সাজেক ভ্রমণের মৌসুম প্রধানত শীতকাল এবং দুই ঈদ। আগস্ট মাস হওয়ায় পর্যটক সম্ভাবনা কম তাই আমরা আটজন যেন তাদের নিকট খরা-মহামারির আকাশে বৃষ্টির ফোটা হিসেবে আবির্ভূত হয়েছি। 

অনেক চেষ্টার পর কৌশলে একজন চালককে আধা কিলোমিটার ফাঁকে ডেকে নিয়ে চার হাজার টাকায় রাজি করাতে সক্ষম হলাম। অথচ খাগড়াছড়ি থেকে দশ হাজার টাকা দাবি করেছিল। অভিজ্ঞজনদের নিকট থেকে শোনা- সাজেক যাওয়া এক সময় অভিযাত্রা বা অভিযান হিসেবে দেখা হতো। এখন সেই দিন আর নেই। কক্সবাজার আর নন্দন পার্কে যাওয়ার মতো বিষয় হয়ে গেছে। তারপরও শেষ পর্যন্ত অন্তত গাড়ি ঠিক করতে পেরে মনে হলো এভারেস্ট জয় করে ফেললাম, অথবা সাঁতার দিয়ে ইংলিশ চ্যানেল পাড়ি দিলাম! বেলা সাড়ে এগারোটার মধ্যে বাঘাই হাট সেনাক্যাম্প পৌঁছতে হবে। সাজেক অভিমুখি যত পর্যটক গাড়ি সেখানে জড়ো হয়। দিনে দুইবার বেলা সাড়ে এগারোটা আর বিকেল তিনটায় স্কোয়াড করে নিয়ে যাওয়া হয়। ক্যাম্পে নাম তালিকাভুক্তির পর যতগুলো গাড়ি জড়ো হলো সামনে পেছনে সেনাবাহিনীর দুইটি গাড়িজুড়ে দিয়ে যাত্রা শুরু। খুবই দুঃখজনক যে নিজ দেশের ভূ-খণ্ডেও পাহাড়ায় চলাচল করতে হয়। সমস্যাটি আজকের নয়, পুরনো।


সর্বশেষ অশান্তির পেরেক প্রথিত হয় ১৯৭১ সালে। যার ভয়াবহ রেশ আজও টানতে হচ্ছে। যাহোক সে অন্য প্রসঙ্গ। গাড়ি চালককে আগেই বলা হয়েছিল, বদ্ধ গাড়িতে বসে থেকে পাহাড় প্রকৃতির মায়াবি রূপ দেখা থেকে নিজেদের বঞ্চিত করতে মোটেও রাজি না, ছাদে ওঠার ব্যবস্থা করে দেওয়া চাই। কথা মতো সেনাক্যাম্পের পর একটি জায়গায় গাড়ি থামিয়ে তিনি ছাদে তুলে নিলেন। প্রথমে দুএকজন তো উঠতে চাইলই না তার উপর দিয়ে অন্যদের ওঠাতেও বিরোধিতা। গনেশ যে উল্টে যাবে তা জানা ছিল। মিনিট বিশেক পর সম্পূর্ণ গাড়ির ভেতরটা ফাঁকা করে তারাও উঠে পড়ল। সাজেক কত দূর কেউ জানি না। এগিয়ে যাচ্ছি তো যাচ্ছি। কি অপরূপ সুন্দর আমাদের পার্বত্য এলাকা, সত্যি করে বলতে গেলে তা কলমের কালিতে বা কম্পিউটারের কি-বোর্ডের বোতাম চেপে বর্ণনা করার সাধ্য আমার নেই। সবুজ সতেজ অজস্র পাহাড় সৌন্দর্য উজার করে রেখেছে। মাঝে মাঝে দুএকটি ছোট্ট বসতি। সোনালী ছনে ছাওয়া ঘারগুলো দিগন্তজোড়া সবুজের মাঝে একেকটি অলঙ্কার যেন। সম্মুখেই পর্বতের সুদীর্ঘ প্রাচীর, আবার খনিক বাদে নিজেরাই আবিষ্কৃত হচ্ছি সেই পর্বত শীর্ষের আঁকাবাঁকা পথে।

মাঝপথে গাড়ির বহর সমর্পিত হলো বর্ডারগার্ড বাংলাদেশের নিকট। এখান থেকে সাজেক পর্যন্ত স্কোয়াডের দায়িত্ব তাদের হাতে। অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে এগিয়ে চলছে চান্দের গাড়ি। পার্বত্য অঞ্চলে বর্তমানে যে সমস্ত বাহন চান্দের গাড়ি বলে পরিচিত তা আসলে চান্দের গাড়ি নয়, টয়োটা, নিশান অথবা ইন্ডিয়ান টাটা কোম্পানির ছাদ খোলা জিপ। সৌভাগ্যক্রমে আমাদের ক্ষেত্রে একটি প্রকৃত চান্দের গাড়িই মিলে যায়। চারপাশ খোলা ব্রিটিশ আমলের জিপ, কদাকার দেখতে। রং চটে গেছে বহু আগে, জায়গায় জায়গায় ছাল-বাকলও খুলে পড়েছে। তবে ইঞ্জিনে বেজায় দম! এসব মিলিয়েই আসলে চান্দের গাড়ির সৌন্দর্য। প্রকৃত সৌন্দর্যটি দেখা যায় যখন এক গাড়িতে ছাদে-বাম্পারে চলিশ-পয়তাল্লিশ জন যাত্রী ওঠে। তখন গাড়ির অবয়ব দেখা যায় না কেবল মানুষ ছাড়া। মাঝে এক পশলা বৃষ্টি হয়ে যাওয়ায় রৌদ্রের তাপ খানিকটা প্রশমিত হলো। ওদিকে ছয় বন্ধুর কণ্ঠে বেজে উঠল-

গাঁজার নৌকা পাহাড়তলী যায়, ও মিয়া বাই

গাঁজা খাব আঁটি আঁটি, মদ খাব বাটি বাটি

ফেন্সি খাইয়া টাশকি লাইগা যাই

ও মিয়া বাই...
 


এই শুরু হলো, তারপর এই গান তো সেই গান, যেন অনন্ত কাল শুধু গেয়েই যাবে। সামনে সুউচ্চ এবং কালো কুচকুচে আর একটি পর্বত প্রাচীর। দেখে মনে হতেই পারে যেন পৃথিবীর শেষ প্রান্তে চলে এলাম, ওটা পেরুলেই আর কিছু নেই! এক ঘণ্টার মধ্যে সুদক্ষ চালক ইসমাইলের কল্যাণে দূর থেকে দেখা পর্বত প্রাচীর আমাদের পদভারে মুখরিত হয়ে উঠল। পৌঁছে গেলাম সাজেক উপত্যকায়।





রাইজিংবিডি/ঢাকা/২৫ মে ২০১৭/তারা 

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়