ঢাকা     শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৭ ১৪৩১

জর্জিয়া: ইউরোপের সবচেয়ে উঁচু বসতিতে

শিল্পী রহমান || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৭:৪৫, ১২ আগস্ট ২০১৭   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
জর্জিয়া: ইউরোপের সবচেয়ে উঁচু বসতিতে

শিল্পী রহমান: ছেলেটা খুব ভালো গাড়ি চালায়। জর্জ ওর নাম, আমাদের টুরিস্ট গাইড। কতগুলো মানুষ আছে খুব অল্প সময়েই নজর কাড়তে পারে, মন জয় করতে পারে- জর্জ সেরকম। খুব চুপচাপ, কিন্তু ওর চুপ করে থাকাটা দূরে ঠেলে দেয় না, আগ্রহ বাড়ায়। জানতে ইচ্ছে করে, বন্ধু হতে ইচ্ছে করে। হয়েও গেল আমাদের বন্ধুত্ব কিছুক্ষণের মধ্যেই।

খুব শান্ত এবং স্বচ্ছন্দে চালাচ্ছে। এক কথায় অত্যন্ত আত্মবিশ্বাসী, নিঃসংশয়ে ঠান্ডা মস্তিষ্কে গাড়ি চালানোকেই আমি পারদর্শী ড্রাইভার বলি। আমরা যাচ্ছি পাহাড়ের চূড়ায়, খুবই আঁকাবাঁকা পাহাড়ি রাস্তা। মাঝে মাঝে দম বন্ধ করা মুহূর্ত আসছে। উঁচু পাহাড় থেকে বরফ গলে পড়া ঝরনাধারা পাহাড়ের গিরি দিয়ে নেমে এসে আমাদের রাস্তার ওপর দিয়ে ভাসিয়ে দিয়ে নেমে গেছে পাশেই হাজার ফুট নিচে নেমে যাওয়া নদীতে।

সেই দুর্গম রাস্তার ওপর দিয়েই গাড়ি চালাচ্ছে জর্জ। বৃষ্টি হচ্ছে। বৃষ্টির পরিমাণ যেন বেড়েই চলছে ওপরে উঠবার সাথে সাথে। এমন রাস্তা দিয়ে যাবো জীবনেও কল্পনা করিনি। একটুও ভয় লাগছিল না আমার বরং রোমাঞ্চকর যাত্রা বলা যেতে পারে। যেতে যেতে হঠাৎ চোখে পড়ল টাওয়ারটি- লাভ টাওয়ার। গ্রামটির নাম কালা। অনেক বছর আগে এখানকার দুই গ্রামের একটি ছেলে এবং একটি মেয়ে একজন আরেকজনকে ভালোবেসেছিল, কিন্তু কেউ এই প্রেম মেনে নিতে রাজি হয়নি বলে ওরা দুই গ্রামের মাঝখানে এঙ্গুরি নদীর ধারে এই টাওয়ার বানিয়ে এখানেই সংসার শুরু করে। এখানেই ছিল ওরা অনেকদিন। ওদের বংশধরদের এখনো দেখা যায় আশপাশের গ্রামে।

 


পুরো সভ্যানিটিকেই টাওয়ারের শহর বললে ভুল হবে না। মোটামুটি প্রত্যেকটা বাসার সাথে রয়েছে  টাওয়ার, যেখানে সাধারণত তারা নিজেদের শত্রুপক্ষ থেকে রক্ষা করবার উদ্দেশে লুকিয়ে রাখতো। খুব একটা যে যুদ্ধ হতো তা কিন্তু নয় তবুও তাদের আত্মরক্ষা করবার জন্যে এই ব্যবস্থা। সেই সাথে ওরা এখানে খাবার দাবারও সংরক্ষণ করতো এবং এখনো করে। এখন অবশ্য ওই দ্বিতীয় কাজটাই বেশি হয়।

উশগুলির অবস্থান সি লেভেল থেকে ৭,১৯০ ফুট ওপরে। এটা ইউরোপের সবচেয়ে উঁচু বসতি বলে খ্যাত যেখানে বছরের ৬ মাস বরফে ঢেকে থাকে। এখানকার জনসংখ্যা মাত্র ২০০। ইউনেস্কো এটাকে ‘ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট’ হিসেবে শনাক্ত করেছে। সভ্যানিটিতে এঙ্গুরি গর্জের পাশে চারটা গ্রামের সমন্বয়ে গড়ে উঠেছে এই উশগুলি।

 


মেস্টিয়া শহর থেকে ৪৫ কিলোমিটার দূরে এই গ্রাম। মেস্টিয়া হচ্ছে সভ্যানিটির রাজধানী। আর পাহাড়ি সভ্যানিটি হচ্ছে জর্জিয়ার উত্তরে অবস্থিত সবচেয়ে দূরবর্তী এবং দুর্গম একটি জায়গা। আর জর্জিয়া হচ্ছে রাশিয়ার উত্তরে ছোট একটি দেশ। যার রাজধানী বিলিসি।

উশগুলিতে যাওয়ার সময় আরো অনেক জায়গায় থেমেছি আমরা। মন মানে না। পায়ে হেঁটে যেতে পারলে সবচেয়ে ভালো হতো। প্রতিটি মুহূর্ত এতো সুন্দর ছিল যে, গাড়িতে ঝিমানোর সুযোগও ছিল না। উশগুলি থেকে ফেরার সময় অবশ্য এক ভদ্রলোককে দেখেছি হাঁটছে। প্রথমে ভেবেছি লোকটা বিপদে পড়েছে বুঝি, আমাদের ড্রাইভার গাড়ি থামিয়ে জিজ্ঞেস করল, উনি কোনো সাহায্য চা্ন কি না? তিনি বললেন, না, তিনি হেঁটে যেতে চান। তখন বিকেল শেষের পথে। একটু পড়ে ঘন অন্ধকারে ডুবে যাবে এই পাহাড়ি এলাকা, কোথাও কোনো আলো নেই। সবাই ওকে পাগল ভাবল, রাত হলে বিপদে পড়তে পারে কিন্তু আমি মনে মনে ভাবলাম, আমারও তো ছিল মনে, কেমনে পারিল বেটা জানিতে। লোকটার মনের ইচ্ছে পূরণ করবার এই সাহসকে ‘সাবাশ’ না দেই কি করে!

এক জায়গা দিয়ে যাচ্ছি। যার বাম পাশে উঁচু পাহাড় ছিল ঠিকই তবে মাঝে মাঝেই সেই পাহাড় একটু দূরে সরে গেছে। সামনে সবুজ প্রান্তর। তার মাঝেই আবার ঝরনাধারা নেমে এসে এক অপূর্ব দৃশ্য তৈরি করেছে। তখন পুরাপুরি তুষারপাত শুরু হয়েছে। চারদিক সাদা হয়ে গেছে তার ভেতর থেকেই আবার হাল্কা সবুজের ছোঁয়া দেখা যাচ্ছে যা পুরোপুরি ঢেকে যায়নি। তার মধ্যে কয়েকটা ঘোড়া সেই জলপ্রপাতের পাশে দাঁড়িয়ে আছে। এমন দৃশ্য ছোটবেলায় ক্যালেন্ডারে দেখেছি। না হলে ন্যাশনাল জিওগ্রাফিতে দেখেছি। দম বন্ধ হয়ে আসা সৌন্দর্য। আমরা চারজনই একসঙ্গে চিৎকার করে উঠেছি যে এখানে গাড়ি থামাতেই হবে। ছবি তুলতেই হবে। এত সৌন্দর্য ক্যমেরা ধরতে পারে না। এতো সৌন্দর্য হৃদয়েও ধারণ করা যায় না, কোথায় যেন অপূর্ণ থাকে, ভাষায়ও প্রকাশ করা যায় না। এ এক অভাবনীয় অনুভূতি। আমি নিজেই তখন ওই ছবির একটা অংশ। ভীষণ ভাগ্যবান মনে হল নিজেকে, পৃথিবীর এই সৌন্দর্য দেখতে পারার এমন মুহূর্ত আমার জীবনে এসেছে বলে। এখানে ছবি তোলার উদ্দেশ্য হলো নিজেকে এই সুন্দরের একটা অংশ ভাবা। হয় না, তবু চেষ্টা- তবু সুন্দর, তবু ভালোলাগা।

পাহাড় থেকে নেমে এসেছে সবুজ ঢালু মাঠ। মাঝখান দিয়ে কল কল করে ছুটে চলছে ঝরনাধারা। কি মধুর সে জলতরঙের শব্দ। একটা মানুষকে অন্য স্তরে নিয়ে যেতে পারে এই স্বর্গীয় পরিবেশ। সেই কারণেই হয়ত এরা অল্পেই খুশি। বাংলাদেশের চাইতে বেশ গরিব এই দেশ। এখানে মানুষ যা আছে তাই নিয়ে সুখে থাকতে শিখেছে। এদের টিপস দিলেও এরা লজ্জা পায়। প্রাপ্তির বাইরে কোনো প্রত্যাশা নেই।

 


পৌঁছে গেলাম ইউরোপের সবচেয়ে উঁচু বসতিতে। দুপুরে কিছু খাওয়া হয়নি। একটাই মাত্র ক্যাফে। ভারী কাঠের দরজা খুলে ঢুকেই মনে হলো আমি একজন কাউবয়। ঘোড়ায় করে ঠান্ডা বরফের মধ্যে অনেকটা পথ এসেছি। ক্যাফের ওম ওম গরমে গা থেকে জ্যাকেট খুলবো, ঝুর ঝুর করে বরফ ঝরে পরবে, হ্যাটটা খুলে কোণায় একটা টেবিলের ওপরে রেখে হেলান দিয়ে বসবো, তারপর আশপাশের সবকিছুতে একবার চোখ বুলিয়ে নিয়ে ওয়াইনের গ্লাসে চুমুক দেবো- এটা ছিল আমার কল্পনা। কিন্তু সেই ভারী কাঠের দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকে কোনো বসার জায়গা পেলাম না। এতক্ষণ মনে হয়েছে কোথাও মানুষ নেই, এখানে এসে বেশ কিছু ট্যুরিস্ট দেখতে পেলাম। আরেকজনের সাথে টেবিলে বসার অনুমতি নিয়ে বসলাম। দেখি আমার সামনের মহিলা খুব রসিয়ে রসিয়ে রেড ওয়াইনে চুমুক দিচ্ছে। জীবনে এই প্রথম আমার কারো ওয়াইন পান করা দেখে ওয়াইন পান করতে ইচ্ছে হলো। অস্ট্রেলিয়াতে সবাই সব জায়গায় ড্রিঙ্ক করছে কখনোই ইচ্ছে হয়নি আমার। এখানে সত্যি মনে হলো, আমি চাই। চাইলামও, কিন্তু মেয়েটা বলল, ওদের ওখানে ড্রাই ওয়াইন আছে অর্থাৎ মজা লাগবে না। বিশেষ করে আমার যেহেতু অভ্যাস নেই। কি আর করা, হলো না সাধ মেটানো। কিন্তু আমার ভালোলাগার পরিমাণ এমন একটা পর্যায়ে ছিল যে এই ছোটখাটো একটা না পাওয়া সামান্য আঁচড়ও কাটতে পারল না।

ওখানে দুপুরের খাওয়া খেয়ে, টুকটাক সুভ্যিনিয়ের কিনে গ্রামটা হেঁটে হেঁটে দেখলাম। বাসাগুলো দেখে আবারও মনে হলো এই মানুষগুলো খুব অল্পে খুশি। পাহাড়ের অনেক নিচে বয়ে যাচ্ছে খরস্রোতা গর্জ এঙ্গুরি, তার পাশ দিয়ে বিশাল উঁচু পাহাড়। তার ওপরে রানীর সামার কটেজ। অন্য পাহাড়গুলোর ওপরে এবং নিচে ছড়িয়ে আছে মানুষের বসতি। এখানেও অনেক টাওয়ারের সমাবেশ। দূরে অবেলায় একটা মোরগ ডাকছে। হাস-মুরগি, গরু, শূকর এবং ঘোড়া আছে মোটামুটি সবার বাসায়। খাওয়ার মধ্যে মাংসই খায় ওরা বেশি, গরু এবং শূকরের মাংসই বেশি। মাছের প্রচলন খুব কম, যা খায় তা বেশির ভাগ বাইরে থেকে আসে। ওদের নিজেদের খুব একটা মাছ নেই।

উশগুলি থেকে ফেরার পথে আকাশ ঝকঝকে হয়ে গেলো। সুন্দর নীল আকাশ। সে আরেক রূপ। কিন্তু আমি বলবো বাজে আবহাওয়াটা আমাদের জন্যে সৌভাগ্য বয়ে এনেছে, কারণ না হলে এর অর্ধেকও দেখা হতো না। কেউ সখ করে বাজে আবহাওয়াতে বের হয় না। সবাই ভালো দিন দেখেই ঘুরতে বের হয় আর তাই দুর্যোগের সৌন্দর্য দেখা হয় না। দুর্গম পথ এবং অনাকাঙ্ক্ষিত আবহাওয়ার কারণে যেই উত্তেজনা বা রোমাঞ্চ বোধ করেছি তা ছিল অভাবনীয়। সত্যি মনে রাখবার মতো।

 

 

রাইজিংবিডি/ঢাকা/১২ আগস্ট ২০১৭/সাইফ/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়