ঢাকা     শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৭ ১৪৩১

বানরের দলের সঙ্গে লাউয়াছড়ার গহীনে

ফেরদৌস জামান || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৮:২০, ১৮ আগস্ট ২০১৭   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
বানরের দলের সঙ্গে লাউয়াছড়ার গহীনে

(চর থেকে চিরসবুজের ডাকে : শেষ কিস্তি)

ফেরদৌস জামান : আকাশে মেঘ কিন্তু বৃষ্টি হচ্ছে না। পাথারের মাঝ দিয়ে সিলেট-শ্রীমঙ্গল সড়ক। ক্যালিপ্টাস গাছগুলো পাশাপাশি দাঁড়িয়ে, সামান্য বাতাসেই আহ্লাদে দুলে উঠছে আর জড়িয়ে ধরছে পরস্পর। বিস্তর ধানক্ষেতে সন্ধ্যাবেলার অজস্র প্রজাপতি পাখা মেলেছে। হয়ত খানিক পরে জেনাকীর দল জেগে উঠবে। নীরব সড়কে একলা বাস ছুটে চলছে বেদম গতিতে। দেখতে দেখতে অন্ধকারের মলিন চাদরে ঢেকে গেল চারপাশ। একটা দুইটা করে লোকালয় পেরিয়ে প্রবেশ করলাম শ্রীমঙ্গল। বাস যাবে মৌলভীবাজার বা হবিগঞ্জের কোথাও। আমাদের নামিয়ে দিলো শহরের এক প্রান্তে। রিকশা এসে ঘিরে ধরল। একটাতে আরোহণ করে তারই কথা মতো নেমে পড়ি শহরের চৌমুনা মোড়ে। সম্মুখেই তিন-চারতলা বড় দালানের হোটেল বিরতি। পাশের বই ব্যবসায়ীর পরামর্শে এখানেই এক রাতের নিবাস পাতলাম। টানা বারান্দা, দাঁড়ালে চারপাশ দেখা যায়। বোঝার উপায় নেই উপজেলা শহর। ব্যস্ত শহর, অনেক রাত অব্দি শোরগোল থাকে। ক্ষুধা পেয়েছে, ভাত খাওয়া দরকার। যে জিনিসটা সর্বক্ষণ এড়িয়ে চলার চেষ্টা করি সুজিতের তালে পড়ে সেই পরোটা খেতে খেতে পেটে কড়া পরে গেছে, তাও আবার কড়া করে ভাজা না হলে তার চলবে না!

 




শহরটা ঘুরে দেখতে হবে। শ্রীমঙ্গল একাধিকবার দেখা কিন্তু আজও ঠিক চিনে উঠতে পারিনি কোথায় কোন রাস্তা! বিকেল থেকেই মোড়ে মোড়ে খুলে বসে চপ আর পিঁয়াজু ভাজার দোকান। দোকানটা ঠিকই চিনে নিতে পেরেছি, গতবার এখানেই খেয়েছিলাম। ভাজাপোড়ার পর এক পেয়ালা চা পান করে আবারও হাঁটছি। পায়ে হেঁটে শহরের প্রধান সড়কের একটাও বোধহয় বাদ রাখলাম না। মাঝে ‘পানসি’ নামক খাবারের দোকানে রাতের খাবার সেরে নিলাম। সুজিতের কড়া ভাজা পরোটা থেকে এ বেলাতেও নিস্তার মিলল না। বেশ আধুনিক দোকান, শত মানুষের ভিড়। হালফ্যাশানের যুবকদের জমজমাট আসর দেখেই আন্দাজ করা যায়- বিলেত ফেরৎ। এখানকার চা দারুণ স্বাদের। চা তো নয় যেন দুধ-চিনির গরম শরবত। চা পাতার স্বাদ খুঁজে না পেলেও মিষ্টি-মধুর রেশ মুখে লেগে থাকে অনেকক্ষণ।


হোটেল কক্ষ নয়, যেন বিদ্যালয়ের শ্রেণীকক্ষ। সংযুক্ত গোসলখানা আর পায়খানা ঘরটাতেই অনায়াসে দুজন থাকার বিছানা পাতা সম্ভব। ঘুমানের দরকার, সকালের গন্তব্য লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যান। এবার কততম হবে মনে নেই, তবে যতবারই এই বনে প্রবেশ করি ততোবারই খুঁজে পাই নতুনত্ব। প্রতিটা জিনিসের ক্ষেত্রেই এমনটা হয়, একই সিনিস একই বিষয় একেকবার একেক রকম বা রূপে ধরা দেয়। সেজন্য মানসিক প্রস্তুতি বা বাস্তবতাটাও বিবেচ্য। যাই হোক, অটোরিকশা, বাস বা অন্য কিছু নয়, এবার লাউয়াছড়া যেতে ভাড়া করলাম রিকশা। যন্ত্রচালিত আধুনিক রিকশা, অল্পবিস্তর অসমতল পথ, পথে অন্য গাড়ির সম্ভাবনা না থাকায় তরুণ চালক গানের তালে এগিয়ে চললো চা বাগানের মাঝ দিয়ে। বনে প্রবেশ করে পনের মিনিট এগিয়েই পেয়ে যাই আব্দুল আহাদ নামক এক কলেজ পড়ুয়া যুবককে। দর্শনার্থী বা পর্যটক নেই, আহাদকে পেয়ে সাহস একটু বাড়ল, তার ক্ষেত্রেও বন ঘুরে দেখার সঙ্গী মিলে গেল। সে বোধহয় এখনও আমাদের উপর ভরসা পাচ্ছে না। অনর্গল কথা বলছে- ভীষণ রকম অপ্রাসঙ্গিক বিষয় নিয়ে। ভয় পেলে বা একলা অন্ধকারে আমরা অহেতুক যেমন করে থাকি। উল্লুকের পেছনে ছুটতে ছুটতে আরোহণ করে বসি টিলার উপর। ঘন জঙ্গল মাড়াতে গিয়ে আহাদের অবস্থা কাহিল। এতক্ষণ সে ভাবতে শুরু করেছে কাদের পাল্লায় পড়লাম রে বাবা! রণে ভঙ্গ দেয়াটাও ইজ্জতের প্রশ্ন- কারণ এতক্ষণ যত গল্প হয়েছে সবখানেই সে নায়ক। সুতরাং পরিস্থিতি তার জন্য সত্যিই বেগতিক।

 




তবে গল্প থেমে নেই। তা চলমান অন্ধকারে পথযাত্রীর মতো। লাউয়াছড়াতে বেশ পুরনো বৃক্ষ রয়েছে, ছায়া পেতে দিয়েছে অনেক উঁচু থেকে। মিষ্টি ছায়ায় কিছুক্ষণ বিশ্রাম করলে মন্দ হয় না। পেরিয়ে গেছে প্রায় দেড় ঘণ্টা। অদূরেই কেউ গাছ বা ডাল কাটছে। আমাদের উপস্থিতি টের পেয়ে থেমে গেল। কাছাকাছি গিয়ে ডাক দিলে দুজন লোক এসে পথ দেখিয়ে দিলো- এদিক দিয়ে গেলেই বের হওয়ার রাস্তা মিলবে। কিসের কি বেরোনোর রাস্তা- বন ছেড়ে ঢুকে পড়েছি অন্য এলাকায়। কানে ভেসে আসছে পট পট বা ঠাস ঠাস ধরণের শব্দ। অজস্র শব্দ আরও নিকটবর্তী হলো। আহাদকে এবার জোর করেই থামাতে হলো। কারণ রাবার বাগানে প্রবেশ করেছি। আগস্ট মাসে রাবার গাছের গোটা ফাটতে শুরু করে। শুকনো ঝনঝনে গুচ্ছ থেকে গোটাগুলো এমন শব্দে ফেটে গিয়ে ছিটকে পড়ছে এদিক সেদিক। এক সাথে এত এত গোটা ফেটে যাওয়ার শব্দে খানিকক্ষণ কান পেতে থাকলে মনে হবে অপূর্ব এক বাদ্যের বাজনা খেলে যাচ্ছে। বাগানের মেঝেজুড়ে ছড়িয়ে রয়েছে অজস্র শুকনো গোটা। বৃষ্টির পানি আর মাটির সংস্পর্শে কিছু গোটা ফেটে মুখ বের করে দিয়েছে লকলকে সবুজ কুঁড়ি।


খানিক দূরেই টিলা থেকে নেমে এসছে এক দল বানর। বহু চেষ্ট করেও সুজিতের উচ্ছ্বলতা থামানো গেল না। কয়েকটা ছবি তুলবেই। যত রকম কলাকৌশল জানা আছে তার সবগুলো প্রায়োগ করে শেষ পর্যন্ত যে কয়টা ছবি তুলতে পেল তাতে বানর নাকি হাতি রয়েছে বোঝা দুষ্কর। এ নিয়ে তার আফসোসের অন্ত নেই, পারে তো বানরের পিছে ছুটতে ছুটতে জীবন শেষ করে দেয়। ওদিকে আব্দুল আহাদ অনর্গল ফাঁক খুঁজছে কখন এই বানর বিষয়ক একটা গল্প বলে নিজেকে আর এক দফা নায়ক সাব্যস্ত করা যায়। বাগানের মাঝ দিয়ে সরু খালে বালির নকশাদার পড়ত, বোধহয় একদিন আগেই বৃষ্টির পানি উছলে গেছে। দুপাশে উঁচু টিলা, মাঝের ছায়াময় সমতল দিয়ে হেঁটে চলেছি। আহাদের দিকে তাকিয়ে এবার বোঝা গেল সত্যি সত্যিই সে বিপদে পড়েছে, যেন এই পথ সারাজীবনেও শেষ হবার নয়! অনেকক্ষণ হয়ে গেল তার মুখে তালা লাগানো, এবার অন্তত নিস্তার দেয়া উচিৎ। কাঠ সংগ্রহরত দুই-তিনজন ক্ষুদ্র জাতিসত্তার মানুষ পেয়ে তাদের সাথে সে নিজের পথ ধরল- ডান দিকে ঘণ্টা দুই হাঁটলেই বনের বাইরে পৌঁছতে পারবে। এদিকে আমরা জানি না কোন দিকে যাচ্ছি তবে এতটুকু নিশ্চিত যে, টানা দুই-আড়াই ঘণ্টা যে কোনো দিকে এগোলে লোকালয়ের দেখা মিলবেই। রাবার বাগানের পর প্রাকৃতিক খাল। খালের ওপাড়ে বিস্তর চা বাগান। এ কোন সৌন্দর্যে এসে পতিত হলাম! টিলাগুলো থরে থরে সবুজের পড়তে সাজানো। রোদ উঠেছে বেশ। চোখ যত দূর যায় কেবলই বাগান, জনমানুষের চিহ্ন নেই। খাল পেরিয়ে ডানে যাবো না বামে সে বিচারে কিছুক্ষণ ব্যয় করার পর ডান দিকেই এগোতে থাকলাম। এবার বোধহয় বামে মোড় নিয়ে টিলা পেরলেই লোকালয়ের দেখা মিলবে।

 




এই টিলা থেকে সেই টিলা করতে করতে পেরিয়ে গেল আরও দুই ঘণ্টা। পানির মজুদ শেষ, বেচারী আহাদ কেটে পড়ে বেঁচেছে, নয়তো এতক্ষণ নিশ্চিৎ বেহুস হয়ে যেত। মিলে গেল চা শ্রমিকদের পল্লী। যতদূর মনে পড়ছে গাড়ো জাতিসত্তার বসবাস। জনমানব শূন্য পল্লীতে একটি মাত্র কিশোরী কলপাড়ে থালাবাসন ঘষামাজায় ব্যস্ত। বোতল ভরে নিয়ে কিশোরীর দেখানো পথ ধরে বিকেল নাগাদ পৌঁছে গেলাম পূর্বসিরাজ নগর নামক এলাকায়। চা বাগান আর একাধিক শ্রমিক পল্লীর মাঝ দিয়ে শুকনো খটখটে মেঠো পথ। যে শ্রমিকদের অমানবিক পরিশ্রম আর কোমল হাতের ছোঁয়ায় বেঁচে থাকে বিস্তর চা বাগান, তাদের জীবন যাপন এতটাই করুণ যে না দেখলে বিশ্বাস করার নয়। হাড্ডি সার হয়ে যাওয়া মানুষগুলোর দিকে তাকানো যায় না, যেন কত কাল পেট ভরে খেতে পায় নি। জীর্ণ থাবার ঘর, কোন মতে মাথা গোঁজার ব্যবস্থা। এত অনাটন আর অপ্রাপ্তির পরও সর্বোচ্চ পরিশ্রম দিয়ে বাঁচিয়ে রাখে একেকটা চা গাছ। কিন্তু তাদের জীবনের কথা ভাববার ফুরসত আমরা বা আমাদের রাষ্ট্র কতটুকু পেয়েছে তা এক বহু পুরনো প্রশ্ন। একটি মাত্র দোকানে ঝুলছে তিন আঙুলসম বুনো কলার কাদি। সারাদিন পর পেটের মধ্যে দাউ দাউ করে জ্বলা ক্ষুধায় তা যে কত বড় ভরসা হয়ে হাজির হলো সে ভাষায় প্রকাশের অতীত! সিরাজ নগর স্ট্যান্ড থেকে অটোরিকশা করে ফিরে এলাম হোটেল বিরতির ঘরটায়। সময় ফুরিয়ে এসেছে, রাত বারোটায় ঢাকার বাস। ফেলে আসা কয়টা দিনের স্মৃতিগুলোর কথা ভেবে বেদনার গুরুভারে মনের মধ্যে যেন টনটন করা এক অনুভূতি বয়ে যেতে থাকল। ফিরতে হবে যান্ত্রিক জীবনে, হতে হবে স্বার্থপর। যুদ্ধ করে বাসে ওঠানামা, আশপাশে তাকানোর সুযোগ নেই। আবার সেই কৃত্রিমতার খোলস পরিধান করা আর মিথ্যা মিথ্যা খেলা!



রাইজিংবিডি/ঢাকা/১৮ আগস্ট ২০১৭/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়