ঢাকা     শুক্রবার   ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৬ ১৪৩১

সিপ্পির পথে ছোট্ট একটা সমস্যা

ফেরদৌস জামান || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৯:৩২, ১৮ সেপ্টেম্বর ২০১৭   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
সিপ্পির পথে ছোট্ট একটা সমস্যা

ফেরদৌস জামান: অ্যালার্ম বাজতেই জেগে দেখি পাশেই কেউ একজন ঘুমাচ্ছে। ঘরওয়ালা হবে হয়ত। বেশি রাতে ফিরে ঘুমিয়ে পরেছে। আমাদের ঘুমন্ত দেখে জাগায়নি। আমরা যাত্রার কাপড়চোপড় পরেই ঘুমিয়েছিলাম উঠেই বেরিয়ে পরব বলে। সূর্য তাপ ছড়ানোর আগেই সিপ্পিতে আরোহণ করতে হবে। শীতের রাত, কুয়াশা ঢাকা অন্ধকার, চলার পথটা কোনো মতে আন্দাজ করা যায়। নির্জন নিস্তব্ধ পথে মাত্র দুজন মানুষ চলছি। পথ উঠে যাচ্ছে উপরের দিকে, সে আর ফুরাবার নয়, যেন আকাশটাই স্পর্শ করে ছাড়বে। আধা ঘণ্টাও হয়নি শরীর ঘামতে শরু করল। অথচ অল্পক্ষণ আগেও এত গরম কাপড় ভেদ করে যেন বরফের অসংখ্য তীর শরীর অবশ করে দিচ্ছিল। এই পরিস্থিতিতে ওগুলো খুলে ফেলাই একমাত্র সমাধান। পথ চলতে এতটুকুও ভয় লাগছে না। এতক্ষণ যতটা এলাম দিনের বেলা হলে এর অর্ধেকও সম্ভব হতো না।

এত দূর হাঁটলাম অথচ সূর্য ওঠার লক্ষণ নেই! প্রায় দুই ঘণ্টা হতে চলল। ঘড়িতে পাঁচটার অ্যালার্ম দেয়া ছিল তাই না? সুজিতকে বলতেই সে কবজি চোখের কাছে তুলে নিয়ে ঘড়ি দেখল। বলল, দাদা, একটা ছোট্ট সমস্যা হয়ে গেছে! কী সমস্যা? সে বলল, অ্যালার্ম আমাদের জাগিয়ে দিয়েছে ঠিকই তবে তা নির্ধারিত সময়েরও এক ঘণ্টা আগে। শুনেছি এক সময় এই এলাকায় বাঘ-ভালুকের অবাধ বিচরণ ছিল। পা যেন আপন মনেই গতি বাড়িয়ে দিল। এই বুঝি দীর্ঘ লোমশ এক ভালুক এসে সামনে দাঁড়ায় আর ঘার সোজা করে দাঁতপাটি জোড়া সামনে বাড়িয়ে ঘোঁৎ ঘোঁৎ করে ওঠে! খানিক আগে প্রকৃতির ডাকের মৃদু সাড়া অনুভূত হয়েছিল। এখন তা পূর্বের জায়গায় ফিরে গেছে। পথের শেষ প্রান্তে পাহাড়ের মাথায় বসার জায়গা। এখানে বসেও স্বস্তি মিলছে না। তিন দিকে জঙ্গল আর এক পাশে খাঁড়া এবং গভীর খাঁদ। কিছুক্ষণ পর ঐ দূরে পূব আকাশটা কমলা আভায় রাঙাতে শুরু করল। ক্রমেই সেই আভা থেকে আলো বেরিয়ে আসছে। আলোর নিচ থেকে স্পষ্ট হয়ে উঠছে একে একে অনেক পাহাড় চূড়া। কালো পাহাড়গুলো এখন গুনে দেখা সম্ভব। গড়াতে গড়াতে আলো এসে ঠেকল আমাদের আশ্রয় কেন্দ্রের চালে।



খাঁড়া প্রাচীর বেয়ে পেঁচানো সরু পথ। বাঁশের রেলিং দিয়ে কোনো মতে নিচে নামার ব্যবস্থা। আলো যতটুকু বেরিয়েছে তাতে পথ পাড়ি দেয়া যায়। দেখা হলো এক দল হাটুরের সাথে। বহু দূর থেকে ঝুরি বোঝাই শস্য নিয়ে রওনা হয়েছে আড়াই-তিন ঘণ্টা আগে। মিষ্টি রোদে ঐ দূরে বসতির সুবিশাল উঠানজুড়ে এক সতেজ প্রভাতের গড়াগড়ি। কাঁচা রোদে লালচে উঠান আরও রাঙিয়ে উঠেছে। এমন একটা প্রভাত মাড়িয়ে সোজা উপস্থিত হলাম পরিচিত কারবারী লাল থান লেন বমের ঘরে। বাজারে যাওয়ার জন্য সবে রওনা করেছেন। দুই কথা বলতেই চিনে নিলেন। পাড়া সুদ্ধ সব পুরুষ রওনা হয়েছে বাজারের দিকে। আমাদের সিপ্পি নিয়ে যাবে কে? ব্যস্ত হয়ে তিনি কয়েক মিনিটের মধ্যে একজনকে ধরে আনলেন। বেটে মত দেখতে, হাতে একটা দা এবং কাঁধে ঝোলানো কাপড়ের থলে। নাম বৈকুন্ঠ।

দামাদামি করে নিলাম। কিন্তু ঠিক বোঝা গেল না এতে সে রাগ করল কি না। কারণ এদের রাগ অথবা হাসি দুটোরই উৎস এবং প্রকাশ আন্দাজ করা জটিল। বিগড়ে গেলে বিপদ আছে। হাটের দিন গ্রাম ফাঁকা। অতএব সেই একমাত্র ভরসা। আবারও নাম জানতে চাওয়ায় পূর্বের মতো শুধু ঠোঁট নড়ে উঠল এবং ঠুস করে একটা মাত্র শব্দ বেড়িয়ে এলো- বৈকু। হাটবার মানে তাদের কর্মব্যস্ততা এবং এক ধরনের উৎসবের দিন। শুধু অকর্মা আর অথর্ব ছাড়া প্রত্যেকেই হাটে যায়। বৈকু এই দুয়ের যে কোনো একটা হবে হয়ত। সুযোগটা সে ভালোভাবেই কাজে লাগাল- এক হাজারের নিচে নামবে না। এবার কিছু খাওয়া দরকার। দোকান খুলেছে। বেশ কয়েকজনের মাঝে গিয়ে বসলাম। সবাই চিনির রসে চুবিয়ে পিঠা খাচ্ছে। এ তাদের চিরাচরিত পিঠার পদ হতে পারে না, সমতল থেকে আমদানিকৃত ফর্মুলা। তেলে ভাজা ময়দা বা আটার গোলাকৃতির পিঠা, পাশে গামলায় চিনির সিরা। পার্বত্য এলাকার উপজেলার বাজারগুলোতে বাঙালি দোকানে এসব পাওয়া যায়। স্টিলের পিরিচে পিঠা, তার উপর এক চামচ করে সিরা ছেড়ে দিয়ে পরিবেশন, ব্যাস। খেতেও ভালো, চলতি পথে খাব বলে কয়েকটা বেঁধেও নিলাম। আর দুজনে পরামর্শ করলাম, শালা বৈকুর বাচ্চা এক টাকাও ছাড় দিল না, দেখিয়ে দেখিয়ে খাব। কারবারীর ঘরে ব্যাগ রেখে ছোট ব্যাগে খাবার ও প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র নিয়ে পা বাড়ালাম সিপ্পি আর সুং-এর পথে। আড়াই তিন ঘণ্টার  পথ। এক ঘণ্টার মতো শুধু উপরে উঠে খানিক নিচে নেমে পাহাড়ের শীর্ষ দিয়ে প্রায় সমতল পথ। এরপর ততোখানি নামা যতখানি উঠেছিলাম। প্রায় সম্পূর্ণ পথের পাশ দিয়ে একটা পাইপ, উঁচুনিচু হয়ে সেও এগিয়ে চলছে। সিপ্পি পাহাড়ের ওপর  ঝরনা থেকে পাড়ায় এই পাইপের মাধ্যমে পানি টেনে আনা হয়েছে। সামনে শুকনো ছড়া, মাথার উপরে পড়তে পড়তে বৃক্ষ। শরীরে শক্তি সঞ্চয়ের জন্য কিছু খাওয়া দরকার। ছড়ার মাঝে ছায়াময় অন্ধকার প্রায় গর্ত, খাওয়ার জন্য ভালো জায়গা। পরিশ্রমের ঠেলায় বৈকুর উপর থেকে সমস্ত রাগ অভিমান দূর হয়ে গেছে।



পথের যা শ্রী, কালেভদ্রে মানুষ চলাচল করে। ছায়া ঢাকা নিস্তব্ধ পথ। এই পথটাই বোধহয় নিয়ে যাবে একেবারে চূড়ায়। বৈকুন্ঠ বলে ব্রিটিশ আমলের পথ। তার কথার ভিত্তি আছে। তবে আমরা এখন ইতিহাসের সেই পর্বে প্রবেশ করছি না। জঙ্গল আর ডালপালায় আবৃত খাঁড়া পথ মাড়িয়ে প্রবেশ করি ঘন বাঁশের এক দুর্ভেদ্য বনে। বন পেরিয়ে সূর্যের আলো ছড়ানো সামনের দৃশ্য দেখে প্রাণ ভরে যায়। জীবনে দুচোখ দিয়ে বহ রকম দৃশ্য দেখার সুযোগ হয়েছে কিন্তু এত অপূর্ব দৃশ্য বোধহয় কমই দেখেছি। নদীর শান্ত ঢেউয়ের মতো একটার পর একটা পাহাড়। পাহাড়ের গায়ে কুয়াশার আবরণ এখনও জড়িয়ে আছে। মুগ্ধতার আচ্ছন্নতা কাটতে কতক্ষণ পেরিয়ে গিয়েছিল মনে নেই। ক্লান্ত শরীর এখন সম্ভব হলে শুয়ে পড়তে চায়। তা যেহেতু হবার নয় অতএব বসে একটু খানাপিনা করা যেতে পারে। কথা বেশি বলাটা যেমন সমস্যা তেমনি কম বলাও সুবিধার নয়। বৈকু কথা বলতেই চায় না। তার উপর দিয়ে বাংলাও বোঝে কম। একটা প্রশ্ন করলে অন্যটার উত্তর দেয়। কোন প্রশ্নের উত্তরে কেবল হা বা না সূচক মাথা ঝাকায়। আবার কখনও সংশয়ের সুবিধাবাদী ঝাকুনি অর্থাৎ হা- না’র মাঝামাঝি। কখনও ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে আর মুচকি হাসে। চল্লিশ মিনিট বিশ্রামের পর পথ প্রদর্শক বৈকুর পেছনে ফিরতি পথ ধরার পালা। ওর জন্য মায়া হলো, নিজ থেকে একটা কথাও বলে না। আমাদের কাছ থেকে কিছুই কি জানার ছিল না?

 

 

রাইজিংবিডি/ঢাকা/১৮ সেপ্টেম্বর ২০১৭/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়