ঢাকা     শুক্রবার   ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৬ ১৪৩১

দামতুয়া-তুক্ক ঝরনার খোঁজে

মো. ইয়ানুর হোসেন || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১১:৩০, ১৯ জানুয়ারি ২০১৮   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
দামতুয়া-তুক্ক ঝরনার খোঁজে

মো. ইয়ানুর হোসেন: চারদিকে মেঘের ভেলা যেন ভেসে বেড়াচ্ছে। জানালা খুলতেই মেঘ ঢুকে যাচ্ছে ঘরের ভেতর। দৃশটা একবার কল্পনা করুন তো! হ্যাঁ, মেঘ পাহাড়ের জনপদ বান্দরবানে ঠিক এভাবেই শুরু হয়েছিল আমাদের সকাল।

সম্প্রতি আমাদের মূল গন্তব্য ছিল বান্দরবান জেলার আলীকদমের দামতুয়া-তুক্ক ঝরনা। এই ঝরনাটি গত বছর আবিষ্কৃত হয়েছে। শুনেই আমি ও আমার বন্ধু শামীম এসেছি এই মায়াবি ঝরনার খোঁজে। ঝরনাটির বিশেষত্ব হলো, দুটি ঝরনা এখানে একসঙ্গে পতিত হয়েছে। পানি প্রবাহের দিক থেকে এটি দেশের অন্যতম বড় ঝরনা। আমরা আগের দিন বিকেলে আদুপাড়ায় পৌঁছে একটি মুরং বাড়িতে রাতে থাকি। বাংলাদেশের সর্বোচ্চ উঁচু থানচি-আলিকদম সড়ক ধরে মেঘের ভেলা ভেদ করে মোটরসাইকেলে পৌঁছে গিয়েছিলাম সেখানে। আমাদের পরিকল্পনা মতো পরদিন সকাল সাতটায় আমরা গন্তব্যের উদ্দেশ্যে রওনা হই। সুরক্ষার জন্য আমরা দুজন গাইড নিয়েছিলাম। একজনকে আমরা আলিকদম থেকে নিয়ে এসেছি। তিনি আমাদের পূর্বপরিচিত। অন্যজন আদুপাড়া থেকে স্থানীয় গাইড।

 


গাইডদের একজন ৭টা উপজাতীয় ভাষা জানত যা আমার ভ্রমণ অনেক সহজ করে দিয়েছিল। এখানে প্রায় ১১টি নৃজাতি গোষ্ঠীর বসবাস। তাদের সবারই প্রায় আলাদা আলাদা ভাষা। ফলে তাদের সঙ্গে কথা বলাটা ছিল খুব কঠিন। গাইডের কল্যাণে আমরা এই ব্যাপারে বিশেষ সুবিধা পাই। পাহাড়ি আঁকাবাঁকা পথ আর ঝিরি ধরে আমরা এগিয়ে চলি গন্তব্যের উদ্দেশ্যে। যাত্রা পথে অনেকগুলো ছোট ঝরনার গর্জন শুনতে শুনতে সামনে এগিয়ে যাই। পথের দুই ধারে জুম ক্ষেতের পাকা ফসল পাহাড়ের বুকে একখণ্ড হলুদ সমুদ্রে রূপ নিয়েছিল। পাখপাখালির কিচিরমিচির আর ঝিরির পানি বয়ে যাওয়ার শব্দ তৈরি করছিল এক অন্যরকম মায়া। যাত্রা পথে অনেকগুলো গ্রাম পড়ে। মজার ব্যাপার, প্রত্যেকটা গ্রাম আলাদা আলাদা নৃ-গোষ্ঠী দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। সবার ভাষা, ধর্ম, খাদ্যাভাস সম্পূর্ণ আলাদা। বাংলাদেশের একমাত্র এই এলাকাতে ব্যাপারটা সবচেয়ে বেশি।

 


তার মধ্যে একটি মুরং পাড়ায় বিরতি নিয়ে আমরা সকালের নাস্তা সেরে নিয়েছিলাম। আমরা সঙ্গে করে কিছু খাবার নিয়ে গিয়েছিলাম আর সঙ্গে ছিল কিছু পাহাড়ি ফল। এরপর আবার শুরু করি আমাদের যাত্রা। পথগুলো সুন্দর থেকে সুন্দর হতে শুরু হতে থাকে। চারদিকের অপরূপ সুন্দরের মাঝে বার বার হারিয়ে যাচ্ছিলাম। চারদিকে কেমন যেন মায়া অনুভব করছিলাম। কুয়াশার সঙ্গে মেঘের দল খেলা করছিল পাহাড়ের চূড়ায়। ঝিরি পথগুলো এতটা শৈল্পিক ছিল যেন শিল্পীর ক্যানভাসে আঁকা ছবি। পাথরের ওপর দিয়ে বয়ে চলা স্বচ্ছ পানির ধারা আর ঘন বনের মধ্য দিয়ে পথচলা তৈরি করছিল এক অন্যরকম মুগ্ধতা। দূর থেকে ভেসে আসছিল ঝরনার পানি পতনের শব্দ। যখন ঝরনার কাছে পৌঁছলাম ভয়ঙ্কর এক সুন্দর রূপ আমাদের চোখের দৃষ্টি স্থির করে দিলো। আমরা অপলক চেয়ে রইলাম- এত সুন্দর যে ভাষায় বর্ণনা করা অসম্ভব। আমি শুধু কল্পনার রাজ্যে হারিয়ে যাচ্ছিলাম। আমাদের প্রায় আড়াই ঘণ্টা সময় লেগেছিল পৌঁছাতে।

 


আমরা প্রায় দুই ঘণ্টা ছিলাম সেখানে। ঝরনার এমন মায়াবি সৌন্দর্য ছেড়ে যেতে একদমই ইচ্ছে করছিল না! তবে ঝরনার আশপাশে অন্যান্য দশর্নাথীদের ফেলে যাওয়া উচ্ছিষ্ট দেখে ব্যথিত হয়েছিলাম। যদিও আমরা ওই উচ্ছিষ্ট পরিষ্কার করে আসি। ঝরনা দেখে ফেরার পথে একটি মুরং বাড়িতে দুপুরের খাবার খেয়ে নিলাম। খাবার হিসেবে ছিল ভাত, বাঁশ কোড়ল আর সেদ্ধ ভুট্টা। একেবারে ভিন্ন রকমের স্বাদ ছিল খাবারগুলোর। আমাদের যাত্রার শেষটি ছিল একদম কল্পনার মতো। হালকা বৃষ্টি হচ্ছিল তার সঙ্গে যোগ দিয়েছে দুষ্টু মেঘ আর রংধনু। চারদিকে যেন আলো আধাঁরির খেলা। পাহাড়ের মানুষগুলো খুবই আন্তরিক কিন্তু একটু লাজুক স্বভাবের। আমরা দুইদিন যে পরিমাণ আতিথেয়তা পেয়েছি তা মনে রাখার মতো।

 


এই ঝরনা এখানকার মানুষে জীবনযাত্রায় অনেকটা পরিবর্তন এনেছে। এখন প্রচুর পর্যটক আসতে শুরু করেছে এখানে। গত বছর আলিকদম-থানচি উদ্বোধনের পর এই মানুষগুলোর জন্য নতুন দিগন্ত খুলে যায়। কিন্তু এই এলাকা পর্যটকবান্ধব নয়। এখানে অবকাঠামোগত উন্নয়ন করা সম্ভব হলে বাংলাদেশের পর্যটনের জন্য এট হতে পারে ট্রাম্পকার্ড। এখন যারা এখানে ভ্রমণ করতে যায়, তারা মূলত পাহাড়িদের বাড়িতে অথবা তাদের সঙ্গে নিয়ে যাওয়া তাবুতে রাত্রিযাপন করে অথবা দিনে এসে দিনে ফিরে যায়।

খাবার এখানে বড় একটা সমস্যা। পর্যটকদের খাবার নিয়ে অনেক বেগ পেতে হয় এখানে। খাবার শহর থেকে বহন করে আনতে হয়। নিরাপত্তার বিষয়টার ওপর আরেকটু জোর দেয়া দরকার। এখানে ভ্রমণ খুব বেশি নিরাপদ না। গাইডের সিদ্ধান্তের ওপরই নির্ভর করতে হয় দশর্নাথীদের। এখানে অবকাঠামো উন্নয়নের পাশাপাশি খাদ্যের সমস্যা ও নিরপত্তার ব্যাপারটা নিশ্চিত করতে পারলে বাংলাদেশের অন্যতম পর্যটন কেন্দ্র হতে পারে দামতুয়া-তুক্ক ঝরনা।



যেভাবে যাবেন: ঢাকা থেকে প্রথমে কক্সবাজারের চকরিয়া বাসস্ট্যান্ড। সেখান থেকে চাঁদের গাড়ি অথবা বাসে আলীকদম। আলীকদম সেনাবাহিনী ক্যাম্প থেকে অনুমতি নিয়ে পানবাজার থেকে মোটরসাইকেল নিয়ে চলে যেতে হবে ১৭ কিলোমিটার নামক এলাকায়। একজন স্থানীয় গাইড নিয়ে ছয় ঘণ্টার মধ্যেই ঘুরে আসতে পারবেন এই ঝরনা থেকে।

 


 

রাইজিংবিডি/ঢাকা/১৯ জানুয়ারি ২০১৮/ফিরোজ/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়