ঢাকা     মঙ্গলবার   ২৩ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১০ ১৪৩১

পামবোক ঝরনায় জুতা হারানোর যন্ত্রণা

ফেরদৌস জামান || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১০:১৭, ১ মার্চ ২০১৮   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
পামবোক ঝরনায় জুতা হারানোর যন্ত্রণা

(ভিয়েতনামের পথে: ১৪ তম পর্ব)
ফেরদৌস জামান : এই পথ নিয়ে যাবে পেমবোক ঝরনায়। বেলা বাড়ার সাথে সাথে স্কুটির সংখ্যা বাড়তে শুরু করেছে। মজা করতে করতে এগিযে যাচ্ছে সবাই ঝরনার টানে। কারও কারও স্কুটি চালানো দেখে ঠিক বোঝা যায়, আজই শিখে নিয়ে পথে নেমেছে। শক্ত কাঠ হয়ে বসে আছে। হঠাৎ হঠাৎ গতির অস্বাভাবিক পরিবর্তনে বাহনটা কখন না জানি নিচ থেকে বের হয়ে দৌড় দেয় তার ঠিক নেই। এখন পর্যন্ত আমরা ছাড়া পদব্রজ পর্যটক আর কাউকে পেলাম না। এক জনকে যদিওবা পেলাম, এক পর্যায়ে তো তাকে হারিয়েই বরং বাঁচলাম। চড়াই-উৎড়াই অনেক হলো। পথের দুই পাশে হলুদ বর্ণের অজস্র ফুল ফুটে রয়েছে। তাতে খেলা করছে মৌমাছির দল। পথ প্রবেশ করল পুরনো বৃক্ষের ঘন জঙ্গল ঘেরা এলাকায়। বৃষ্টি শেষে এদিকটার আকাশ পরিষ্কার। বৃষ্টির ফাঁক গলে ঝরে পরছে মিষ্টি আলো। জানি না পথ থেকে ঝরনা কত দূরে রয়েছে। গিয়ে বেলা থাকতে থাকতে ফিরে আসতে পারব তো? এমন ভাবনা মনের মধ্যে বারবার এসে ঘোরাঘুরি করছে। পথ যেদিকে যায় যাক। আপাতত এসব ভাবনা দূরে সরিয়ে রেখে দেখতে চাই প্রকৃতির বিচিত্র রূপ, উপভোগ করতে চাই সৌন্দর্য।

ঝরনার স্বভাবটাই এমন, চাইলেও নিজেকে লুকিয়ে রাখতে পারে না। পাখির গুঞ্জন আর মৃদু বাতাসে কেঁপে ওঠা লতাপাতার শব্দ ভেদ করে ভেসে আসছে ঝরনার সেই চিরাচরিত সুর। বৃক্ষের ছায়ায় ছমছমে নীরবতার মাঝ দিয়ে পথ নেমে গেল অনেকটা নিচে। একটা ছাউনি, তার পাশ দিয়ে গলগল করে নেমে আসছে ফেনা তোলা পানির ধারা। সাঁকো পেরিয়ে পথ চলে গেছে সোজা আর ডান পাশে নেমে গেছে ঝরনার পথ। ছোট্ট ছাউনির নিচে বসার জায়গা। আমরা খানিকটা হতাশ কারণ প্রত্যাশা ছিল অনেক বেশি। সামনে যেটা দেখা যাচ্ছে তা পমবোকের প্রথম ধাপ। এর উপরে রয়েছে আর এক ধাপ। জানার পর আবারও যেন আশা করার অবলম্বন খুঁজে পেলাম। সামনে অনেকগুলো স্কুটি সার করে রাখা। এরা কি সকলেই ঐ ঝরনা দেখতে উপরে গেছে? এখনও অনেকে আসছে। আবার কেউ বা ঝরনা দেখে সাবধানে নেমে আসছে।



আমাদের বিশ্রামের  প্রায় পনের মিনিট হয়ে গেছে। এক সাথে কয়েকজন মিলে পুনরায় রওনা হলাম। খানিক ওঠার পর লোহার সরু একটা সাঁকো দিয়ে খালের দুই প্রাচীর সংযুক্ত করা। রেলিং ধরে এগিয়ে গেলে দেখা মেলে বেশ কয়েক জনের জটলা। অতিরিক্ত কাপড়চোপড় না থাকায় ঝরনায় নামতে পারিনি। সেই কষ্টে শোক সমাবেশ চলমান। কয়েক মিটার এগিয়ে পুনরায় উঁচুতে উঠতেই ঝরনার উপরের ধাপ দৃশ্যমান হলো। গভীর এক খাদের একেবারে শেষ প্রান্তে মোটামুটি চওড়া ও উঁচু অবয়ব নিয়ে ঝরছে দুর্দান্ত গতিতে। ঝরনার নিচে পুকুরের মত এক চওড়া গর্ত। আনন্দে আত্মহারা রমণীরা বিকিনি পড়ে নেমে পড়েছে। মহা আনন্দে চলছে তাদের পেমবোক স্নান। পানির তলদেশে অজস্র পাথর। ভিজতে না চাওয়া অনেকেই এ-পাথর সে-পাথর এমন করে এক পা দুই পা এগিয়ে যেতে চায় ঝরনার যথাসম্ভব কাছাকাছি। এদের মধ্যে কয়েক জন পা পিছলে ঝপাত শব্দে পরে গেল। কে দেখে তাদের দুঃখ। উপরে গুহার মত জায়গাটাকে আমরা বিশ্রামস্থান বানিয়ে ফেললাম। দেখাদেখি যোগ দিল আরও কয়েক জন। তাদের মাঝে এক রমণী আরও উপর থেকে সন্তর্পণে নেমে এলেন। তৃতীয় কোন ধাপ আছে কিনা তা আবিষ্কারের দুর্নিবার ইচ্ছায় খ্যান্ত দিয়ে আপাতত আমাদের কাছে আশ্রয় গহণ করলেন।

পূর্ণ প্রস্তুতি থাকার পরও ঝরনায় ভিজব কি না তা নিয়ে ভাবনায় পরে গেলাম। একটু শীত শীত লাগছে, গর্তের পানি ঘোলা বানিয়ে ফেলেছে, ঝরনার পানিতে ভেজার বিস্তর অভিজ্ঞতা আছে। এমন সব নানা অজুহাতে ঝরনায় না নামার স্বপ্ন নিজেদের মধ্যে এক শক্ত অবস্থান তৈরি করে ফেললাম। কিন্তু পানির পিপাসা নিবারণের কি ব্যবস্থা করা যায়? দুজনেরই বেজায় পিপাসা পেয়েছে, সেই দেড়-দুই ঘণ্টা আগে। তখন থেকেই নিয়ত করে রেখেছি ঝরনার নিচে গিয়ে হা করে গলাটা লাগিয়ে দেব। এ পর্যায়ে এটাই হতে পারে ঝরনায় নামার একমাত্র কারণ। কিন্তু উপর থেকে পানি যা ঝরছে তা পান করার অনুপযোগী। সবে বৃষ্টি হয়ে গেছে আর বৃষ্টির পরপরই স্বচ্ছ পানি প্রত্যাশার অতীত। এতক্ষণ পিপাসার কথা মনে ছিল না। মনে পড়তেই সুজিত তো এখন নামবে এবং নামবেই। ঘোলা পানি পান করে কলেরা, ডাইরিয়া হলেও সই। পিপাসা এতটাই ছিল যে, নিজেরও মনে হচ্ছিল নেমে পড়ি। আপাতত তৃষ্ণাকে বশ মানিয়ে অন্তত ঝরনার কাছাকাছি গিয়ে দু’চারটা ছবি তোলায় মনস্থির করলাম। অল্পক্ষণ আগেই কয়েকজন যেভাবে উল্টে পড়ল, সেটাও ভাবনার বিষয়। জুতা-স্যান্ডেল খুলে শেকড়বাকর আর পাথরের খাঁজ-খানাখন্দের উপর ভরসা রেখে নেমে পরলাম। অতি সাবধানে পাথরে পাথরে পা রেখে যতদূর পারা গেল এগিয়ে মনের এই আশাটুকুর বাস্তবায়ন ঘটাতে সক্ষম হলাম। যাওয়া আসার পথে উল্টে পরা দু’এক জনকে উদ্ধারাভিযানে হাতটাও বাড়াতে হলো।



ফেরার সময় হয়ে এলো। বসার জায়গাটায় আর এক দফা বিশ্রাম করতে গিয়ে লক্ষ করলাম, পাশেই মাটি ফুড়ে বেরিয়ে আসা নলটার মাথায় একটা চকচকে ট্যাপ। নিরাপদ পানি পানের সুন্দর ব্যবস্থা। পেয়ে দুজনে তার উপর হামলে পরার মত দৌড় দিলাম। পেট ভরে পানি পান করার পর ফিরতি পথে মাত্র পা বাড়িয়েছি অমনি এক ক্যারিবিয় গাড়ির দেখা মিলল। এগিয়ে যাচ্ছে আমাদেরই পথে। চালকের পাশে বসা লোকটা পুলিশ অথবা মিলিটারি সদস্য হয়ে থাকবে। তাকে পরিস্থিতিটা বুঝিয়ে বলার সুযোগ নেই, তার অবশ্য খুব একটা প্রয়োজনও পড়ল না। দুই কথা শোনার পর যা বললেন তাতে বুঝে নিলাম, তোমাদের যদি কোন সমস্যা না থাকে তাহলে পেছনে উঠে পড়। কাকতালীয় এমন কিছু যে ঘটে যেতে পারে তা ভাবতেই পারিনি। ওরে বাবা কি ভয়ানক গতি সে গাড়ির! পাহাড়ি পথে এমন গতি স্বপ্নেও ভাবা যায় না। অবশ্য তার জন্য ভালো রাস্তা এবং নিয়ম শৃঙ্ক্ষলা থাকা আবশ্যক, যা এদের আছে।

আনন্দে আত্মহারা পর্যটক এখন যেন পাখি, শুধু পাখা মেলাটাই বাকি। ওটা থাকলে পথ প্রদর্শক হয়ে দেখে বেড়াতাম এই প্রকৃতি, এই সৌন্দর্যের প্রতিটি শাখা-প্রশাখা, রস আর গন্ধ! দেখে যাও জীবন কত সুন্দর, স্বপ্ন কত বড়! আমার বুটজোড়া কই? কি সর্বনাশ! ফেলে এসেছি বিশ্রামাগারে। ওটা ছাড়া তো চলবে না, যে করেই হোক উদ্ধার করেত হবে। গাড়ি থামিয়ে নেমে পড়লাম আর সুজিতকে গিয়ে অপেক্ষা করতে বললাম, মহাসড়কের সেই বিশ্রামাগারে। দুরন্ত গাড়ি কয়েক মিনিটেই টেনে এসেছে সেই ল্যান্ড স্পিট এলাকায়। কি আর করা, হাঁটছি আবারও পেমবোকের দিকে। আপাতত মাথাজুড়ে নানান ভাবনা। তার মধ্যে সবচেয়ে বড় জায়গা দখল করে আছে জুতা। খামাখা হাঁটছি কেন? একটা কাজ করলে কেমন হয়। এই যে কিছুক্ষণ পরপর স্কুটি যাচ্ছে, এদের কোন একটায় উঠে পড়লেই হয়। হাত তুলে সাহায্যের সংকেত দিতে একেবারে প্রথমটাতেই কাজ হয়ে গেল। ব্যাস, আরাম করে চেপে বসলাম। গল্পে গল্পে পৌঁছে গেলাম জায়গামতো। এতক্ষণ ভ্রুক্ষেপ করিনি, ঠিক পেছনের স্কুটিতেই ছিল তার প্রেমিকা। গন্তব্যে নেমেই আলাপ পরিচয়ের পর জানা গেল সুদূর ইউএসএ থেকে এসেছে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার এই শ্যামদেশ ঘুরে দেখতে। তাদের উপকারে আমি যতটা না ধন্য, উপকার করতে পারার তৃপ্তিতে তার চেয়ে অধিক ধন্য বরং তারা। জুতাজোড়া আমার যেখানে রাখা ছিল ঠিক সেখানেই আছে।



জুতা ফিরে পাওয়ার খুশিতে তখনই ফিরতি পথ ধরলাম। অজান্তেই মুখ থেকে বেড়িয়ে আসছে প্রিয় গানের গুনগুন সুর। সুজিত বসে বসে এতক্ষণে নিশ্চই ঝিমিয়ে পরেছে। কিছুদূর যেতে না যেতেই আবারও এক হৃদয়বানের দেখা পেয়ে গেলাম। পৌঁছে গেলাম জায়গামতো। আমার অপ্রত্যাশিত উপস্থিতি ক্লান্তি ঝেড়ে সুজিতকে মুহূর্তেই সটান দাঁড় করিয়ে দিল। প্রথম প্রশ্ন জুতা পাওয়া গেছে? পাওয়া গেছে মানে, এই তো আমার পায়ে। চল এবার তবে শুরু করা যাক পাই ক্যানিয়ন অভিযান।



রাইজিংবিডি/ঢাকা/১ মার্চ ২০১৮/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়