ঢাকা     শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৭ ১৪৩১

ওয়াট মে ইয়েনে একবেলা

ফেরদৌস জামান || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০২:২১, ১৭ মার্চ ২০১৮   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
ওয়াট মে ইয়েনে একবেলা

(ভিয়েতনামের পথে: ১৮তম পর্ব)

ফেরদৌস জামান: পথ চিনতে আর কোনো অসুবিধা হবার কথা নয় কারণ ঐ সবুজ পাহাড়, আর ঠিক তার মাঝ থেকে সাদা মূর্তির ডান পাশটা এখন আমাদের সামনে স্পষ্ট দৃশ্যমান। পরিষ্কার, পরিপাটি এবং নিস্তব্ধ বসতির মাঝ দিয়ে বেশ খানিকটা পথ এগিয়ে গেলে মন্দিরের সদর দরজা। এখানে মন্দির বা উপাসনালয় বলতেই তার সদর দরজা একেকটা তোরণ এবং দুই পাশে সিংহ বা ড্রাগন অথবা উভয় পাশে প্রাণীসদৃশ্য মূর্তি স্থাপন করা। তোরণের মাথায় কি লেখা তা নিশ্চয় বুঝবার কথা নয়, তবে এটা অন্তত নিশ্চিত করে বলা যায় যে, ওটাই ওয়াট মে ইয়েনের প্রবেশ দ্বার।

প্রবেশের পর ক্রমেই উঁচুতে উঠে যাওয়া পথের দু’ধারে কিছু ঘরবাড়ি কিন্তু জনশূন্য। মানুষের যে বসবাস নেই তা নয়, তবে সাড়াশব্দহীন। মোটরসাইকেল দাঁড় করানো, কাপড়চোপড় রশিতে ঝুলছে, প্রাচীরের গোড়ায় সাদা কুকুরটাও নিশ্চল দাঁড়িয়ে আছে, গাছে গাছে পাতাগুলো অনড়, যেন কবে কোন কালে প্রলয় হয়ে গেছে, টিকে আছে শুধু মাত্র এই সব নিস্তব্ধ চিহ্নসমূহ। এমন পরিবেশের মাঝ দিয়ে হেঁটে যেতে দিনের আলোতেও কেমন ভূতুরে ভূতুরে লাগল। কি অদ্ভুত ব্যাপার! সেই ভূতুরে নগরের মাঝে নিজেদের আর মানুষ মনে হচ্ছে না, যেন অন্য কিছু। কিন্তু এই অন্য কিছুটা কি তাও অনুভবের অতীত।
 


থাইল্যান্ড, মিয়ানমার, বাংলাদেশের পার্বত্য অঞ্চল তথা অত্র অঞ্চলের দেশগুলোর পাহাড়ি জাতীগোষ্ঠী নৃতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্য বেশ কাছাকাছি। তারা স্বভাবে নম্র এবং স্বল্পবাক, বিনা প্রয়োজনে কথা না বলা তাদের অভ্যাস। তার অর্থ তো এমন হতে পারে না যে, অন্য প্রজাতীর মানুষ যাদের কাজই কথা বলা তাদের জন্য এক ভূতুরে পরিবেশ তৈরি করে রাখবে! কয়েক মিনিট এগিয়ে গেলে দেখা দেয় হালকা শ্যাওলা পরা সিঁড়ি। বৃক্ষের মাঝ দিয়ে উঠে গেছে পাহাড়ের উপর। উঠে যেতে যেতে সিঁড়ির শেষ প্রান্ত অদৃশ্য হয়ে গেছে।

এই সিঁড়িই আমাদের নিয়ে গেল অনেকটা উপরে। পেছন ফিরে তাকালে দেখা যায় উঠে এসেছি পাই এর মাথার উপর। এক পর্যায়ে সিঁড়ি থেমে গেল বাম দিক থেকে উঠে আসা এক পীচ ঢালা পথে। যেন সিঁড়ির অনন্ত এগিয়ে যাওয়ার মাঝখান দিয়ে হঠাৎ এসে তীরের ফলার মতো ভেদ করে গেছে এক সরু রাস্তা। রাস্তা পেরিয়ে আবারও সিঁড়ি। এই পর্যায়ের পুরনো ধাচের সিঁড়ি মাড়িয়ে পদার্পণ করলাম এক মন্দিরের উঠানে। বাম পাশে ছাউনির নিচে স্বর্ণের মতো চকচকে বিভিন্ন আকৃতি ও নকশার গোটা ছয়েক বুদ্ধ মূর্তি। তার সম্মুখে একটা দানবাক্স। এতটা পথ আরোহণের পর এবার সামনের দিকে কয়েকটা চওড়া সিঁড়ি ভেঙ্গে নিচে নামা। এখান থেকে এক দেড়শ ফুট বা তারও বেশি দীর্ঘ লাল ইট দিয়ে সদ্য নির্মিত চওড়া প্রাচীর।
 


পারিপার্শ্বিকতা দেখে অনুমান করা যায় এটা প্রাচীন কোনো স্থাপনা নয়। হাজার বছরের পুরনো স্থাপনা নিদর্শনের একটা রূপ দেয়ার চেষ্টা মাত্র। প্রাচীর থেকে শুরু করে পূর্ব দিকে একেবারে পাহাড়ের গোড়া পর্যন্ত সুপ্রশস্ত এক প্রাঙ্গণ। পাহাড়ের উঁচুতে বকের পালকের মতো সাদা ধবধবে বুদ্ধ মূর্তি। সবুজ অরণ্যের মাঝ থেকে কেবল মাথাটা বেরিয়ে আছে। জনমানবশূন্য প্রাঙ্গণের এক প্রান্তের কোণায় একাকি এক দোকান। এখান থেকে জানিয়ে দেয়া হলো হাফ প্যান্ট পড়ে উপরে আরোহণ নিষেধ। চিন্তার কারণ নেই। দুজনের ব্যাগেই সঙ্গের সাথীর মতো রয়েছে একটা করে গামছা। এ পর্যায়েও সিঁড়ি বেয়ে উঠতে হবে। রেলিং এর আকার নিয়ে উপর থেকে সিঁড়ির গোড়া পর্যন্ত নেমে এসেছে দুই পাশে দুটি ড্রাগন। প্রতিটির ঘার থেকে বেরিয়ে এসেছে তিনটি করে রুদ্র মূর্তি মাথা। উপরে আরোহণের পর উন্নত মেঝের মাঝখানে স্থাপিত হয়েছে ধ্যানমগ্ন সুবিশাল বুদ্ধ মূর্তি, যেন শহরের মাথার উপর বসে শুভ ও কল্যাণের দৃষ্টি রেখেছে অনুক্ষণ। মূর্তিকে পেছনে রেখে সামনের দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করলে চোখের সামনে ভেসে ওঠে ছোট্ট শহর পাই। শহরের পাশ দিয়ে এঁকেবেঁকে বয়ে চলেছে লিকলিকে নদী। অনুচ্চ দালানকোঠা আর ছোট্ট জনপদের মাথার উপর দিয়ে ভেসে বেড়াচ্ছে দু’চারটা মেঘের পাল। খানিক পর একজন, দুজন করে পর্যটক-দর্শনার্থী আসতে শুরু করলো। তাদের কেউ কেউ হাফ প্যান্ট পরিহিত। নবনির্মিত মূর্তিটাকে ঘিরে নেই কোনো অতিসজ্জা, নেই কোনো বাড়াবাড়ি। খুবই সাদামাটা, কি ভিষণ নীরবতা! প্রাণ ভরে চারপাশটা অবলোকনের পর যথারীতি নেমে এলাম প্রাঙ্গণটায়।

দুই-তিনটা গাড়ি এসে ঢুকেছে। দোকানে উল সুতায় বোনা বাচ্চাদের কিছু গরম টুপি দেখেছিলাম। দাম জানতে চাইলে একশ পঞ্চাশের জায়গায় ভুল করে বলে ফেলে পনের বাথ। তখনই ঠিক করে রেখেছিলাম একটা নয় দুটো নয় অন্তত গোটা পাঁচেক কিনব। এখন দেখি দোকানে আগের সেই নারী বিক্রেতা নেই, তার স্থলে অন্য কেউ। চা-কফি কিছু একটা পান করা দরকার, সম্ভব হলে তার সাথে অন্য আরও কিছু। খাওয়াদাওয়া পরে আগে আমার পনের বাথের টুপি কিনতে হবে। সুন্দর বুনন ও নকশার বেশ কয়েকটা বাছাই শেষে দাম মেটানোর আগে প্রকৃত মূল্য জানার পর হাতে যেন গরম লৌহ দন্ডের ছেঁকা খেলাম। এবার তবে টুপি রেখে কফিই পান করা যাক। সাথে নিলাম এক প্যাকেট কলার চিপস্। সুজিত মুখে দিয়ে ওয়াক থু বলে ফেলে দিলো। হ্যাঁ, সত্যিই ওয়াক থু ধরণের চিপস্। পাকা কলার লম্বা ফালি করা চিপস্, তাও আবার কটমটে শক্ত। ওদিকে হন্ডিয়ান ভদ্রলোকের কাপ নুডুলস্ প্রস্তুত এখনও চলমান। উপরে আরোহণের আগে শক্তি সঞ্চয় করে নিচ্ছেন। ব্যাগে করে নিয়ে এসেছেন ডিম। নুডুলসের মধ্যে কাঁচা ডিম ঢেলে কি না কি বানাচ্ছে তা ওর চোখমুখ দেখেই অনুমান করা যাচ্ছে।
 


কাপে গরম পানি ঢালার সাথে সাথে তার কায়কারবারে দোকান কেঁপে উঠল। গরমের ঠেলায় না পারছে দাঁড়িয়ে থাকতে, না পারছে কাপটা ফেলে দিতে। হাতটা সামনের দিকে সোজা করে বাড়িয়ে একরকম দৌড় শুরু করল। তবুও কাপ ছাড়ছে না অথবা সে কথা ভুলে গেছে। বলা যেতে পারে মস্তিষ্ক ঠিক মতো কাজ করছে না। ওদিকে তার খ্যামটা নাচের ধাক্কায় দোকানের সামনে সাজানো বিস্কুট, চিপস্ আর কোমল পানিয়র বোতল মাটিতে গড়াগড়ি করছে। হা হুতাশ করতে করতে দোকানি সেসব রক্ষা করতে গিয়ে ফ্রিজটাতে সজোরে এমন ধাক্কা লাগলো, এই বুঝি ওটা আবার শরীরের উপর পরে ভর্তা বানিয়ে দেয়। এত যত্নের ডিম, নিঃসন্দেহে দেশ থেকে বয়ে আনা। ইচ্ছে হলো দাদাকে জিজ্ঞেস করে দেখি, ব্যাগে আর দু’একটা আছে কি না। পড়শি বলে কথা, নিশ্চই না বলবেন না। এসব দেখতে দেখতে পেরিয়ে গেছে বেশ খানিকটা সময়। প্রথম কাপের পর ফুঁ দিয়ে দ্বিতীয় কাপে চুমুক চলছে আর মনে মনে ভিক্ষু-শ্রমণ জাতীয় কাউকে প্রত্যাশা করছি। এমন জায়গায় এলাম অথচ, তার আদ্যপান্ত না হোক সামান্যতম খবরাখবর নেব না? মন্দির গৃহের আশপাশে কিছুক্ষণ পায়চারী করে এক রূপ হতাশাকে সাথে নিয়েই বিদায় হতে হলো।



রাইজিংবিডি/ঢাকা/১৭ মার্চ ২০১৮/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়