ঢাকা     শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৭ ১৪৩১

প্রজাপতির পাখায় উড়ে ঘুরে এলাম ভুটান : দ্বিতীয় পর্ব

শিহাব শাহরিয়ার || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১১:১৮, ৭ এপ্রিল ২০১৮   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
প্রজাপতির পাখায় উড়ে ঘুরে এলাম ভুটান : দ্বিতীয় পর্ব

শিহাব শাহরিয়ার : এই প্রথম কোচবিহারে এলাম। আমি যখন বাংলাদেশের কোচ জনগোষ্ঠী নিয়ে পিএইচ.ডি গবেষণার জন্য কাজ করছিলাম, তখন একবার কোচবিহার যাবার পরিকল্পনা করেছিলাম কিন্তু যাওয়া হয়নি। আমাদের জন্য দুটো গাড়ি এসে দাঁড়িয়ে ছিল। গাড়িচালক উন সু ওয়াংডিই আমাদের ভুটানের গাইড। চমৎকার একটি ছেলে। সে আমাদের নিয়ে যাত্রা করল ভুটানের প্রান্তের শহর ফুউন্টসেলিঙের দিকে। চেংরাবান্দা থেকে ফুউন্টসেলিং পর্যন্ত যেতে সময় লাগবে তিন ঘণ্টার মতো। আমরা প্রথমে কোচবিহার তারপর জলপাইগুড়ি, তারপর জয়গাঁও হয়ে ঢুকবো ফুউন্টসেলিং।

আমরা যাচ্ছি। পাকা পথ। কোচবিহারের প্রথম জায়গাটির নাম জলঢাকা, যেটি কুড়িগ্রামেও আছে। দেখলাম জলঢাকার মাঝখান দিয়ে সেই কাঁটাতারের বেড়া।  যেতে যেতে দেখলাম কোচবিহার ও জলপাইগুড়ির মানুষ, ঘর-বাড়ি, ফসলের মাঠ, নদী-নালা। তিনটি নদীর দেখা পেলাম- তিস্তা, ধুপধুপ, ঢুলঢুল। পুরো অঞ্চলটিকেই মনে হলো দারিদ্র্যে ভরা। ভুটানের পাদদেশে একটি বিশাল চা বাগানের পাশেই জয়গাঁও। সবচেয়ে নোংরা লাগল জয়গাঁও। ছোট্ট একটি অপরিষ্কার, অবহেলিত ও অপরিচ্ছন্ন শহর। এখানে আরেকবার ইমিগ্রেশন শেষে মাত্র একটি গেট অতিক্রম করেই ঢুকলাম ভুটানে। নাম ভুটান গেট। অবিশ্বাস্য! যেন বাতির নিচে অন্ধকার। গেটের এক পাশে জয়গাঁও নোংরা আর অপর পারে ছিমছাম সুন্দর। ফুন্টশোলিং ইউরোপীয় আদলে গড়ে তোলা ছোট্ট শহর। ঢুকেই আমাদের সকলের যাত্রা পথের ক্লান্তি দূর হয়ে গেল। ওয়েংডি গেটের পাশেই এশিয়ান হোটেলে আমাদের জন্য থাকার ব্যবস্থা করেছে। দারুণ সুন্দর পরিবেশ হোটেলের। ঠান্ডার দেশ তবু ভারতের কাছাকাছি বলে রুমগুলো শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত। হোটেলে ব্যাগ ও লাগেজ রেখে প্রথমে গেলাম ইমিগ্রেশন অফিসে। এরপর শহর দেখতে বের হলাম।



আমাদের হোটেলের পাশেই একটি ছোট্ট পার্ক। পার্কটি ও আশপাশের উঁচু-নিচু ঢালু পথ বেয়ে সন্ধ্যা-উত্তীর্ণ রাতে বেশ কিছুক্ষণ ঘোরাঘুরি করলাম। অনেকটা ভারতের ইম্ফল, শিলং ও দার্জিলিঙের কিছু জায়গার মতো- এই শহর। পাহাড়ি অন্যান্য শহরের ন্যায় এখানেও দেখলাম সন্ধ্যার পর পরই দোকানপাট ধীরে ধীরে বন্ধ হয়ে যেতে। এরপর ফিরে এলাম হোটেলে। এখানে প্রত্যেক হোটেলের সঙ্গে রেস্টুরেন্ট আছে। আমরা উঠেছি দোতলায় আর রেস্টুরেন্ট তিন তলায়। উপরে উঠলাম, দেখলাম বেশ সুন্দর রেস্টুরেন্ট এবং মজার বিষয় হলো, আমাদের দেশের জলচকির মতো ছোট চকি বা টেবিল বলতে পারি, কয়েকটি পাতা আছে আর খাবার খেতে হবে মেঝেতে বসে। খাবার খাওয়ার কতটা আরাম তাতে, তার চেয়ে বিষয়টি অভিনব। তবে বাচ্চাসহ সবাই অন্যরকম ব্যবস্থাপনা এবং খাবারগুলোও অন্যরকম- সুস্বাদু। মজা লাগল। খেয়ে এসেই ক্লান্তিতে ঘুমিয়ে পড়লাম।



পরদিন সকাল সকাল ওয়েংডি এসে ওর গাড়িতে করে আমাদেরকে নিয়ে চলল ভুটানের বর্তমান রাজধানী থিম্পুতে। সে ভাল ইংরেজি, হিন্দি ও থোরা থোরা বাংলা জানে। বলল, ফুন্টশোলিং থেকে থিম্পু যেতে ৬ থেকে ৭ ঘণ্টা সময় লাগবে, পুরোটাই পাহাড়ি পথ। মনে মনে ভাবলাম এক নতুন অভিজ্ঞতা হবে। তবে আমি তামাবিল থেকে শিলং পর্যন্ত তিন ঘণ্টা এবং শিলিগুড়ি থেকে দার্জিলিঙ তিন ঘণ্টায় এরকম পাহাড়ি পথে যাবার পূর্ব অভিজ্ঞতা আছে। দেখা যাক। সুন্দর রোদের সকাল। গাড়ি ছুটছে, আমি কল্পনায় আনলাম থিম্পু। থিম্পু ভুটানের পশ্চিম অংশে অবস্থিত দেশটির রাজধানী শহর। শহরটি হিমালয় পর্বতমালার একটি উঁচু উপত্যকায় অবস্থিত। থিম্পু শহরটি আশেপাশের উপত্যকা এলাকায় উৎপাদিত কৃষি দ্রব্যের একটি বাজারকেন্দ্র। এখানে খাবার ও কাঠ প্রক্রিয়াজাত করা হয়। থিম্পু দেশের অন্যান্য অংশ এবং দক্ষিণে ভারতের সাথে একটি মহাসড়ক ব্যবস্থার মাধ্যমে সংযুক্ত। তবে শহরটির সাথে কোন বিমান যোগাযোগের ব্যবস্থা নেই। থিম্পুতে ভুটানের রাজপ্রাসাদ এবং দেশের বৃহত্তম বৌদ্ধমন্দিরগুলোর একটি অবস্থিত। অতীতে থিম্পু দেশটির শীতকালীন রাজধানী ছিল আর পুনাখা ছিল গ্রীষ্মকালীন রাজধানী। ১৯৬২ সালে শহরটিকে দেশের স্থায়ী প্রশাসনিক কেন্দ্রে পরিণত করা হয়। ভুটানে কোনো রেলপথ নেই। এই শহরটির নিকটবর্তী বিমানবন্দর ৫৪ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত পারো আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর, যা দেশের একমাত্র আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর। চাংলিমিথাং স্টেডিয়াম থিম্পুর একটি বহুমুখী ও ভুটানের জাতীয় স্টেডিয়াম। ১৯৭৪ সালে চতুর্থ ড্রুক গিয়াল্পো, জিগমে সিংয়ে ওয়াংচুক-এর রাজ্যাভিষেকের উদযাপনের জন্য নির্মিত হয়। নির্মাণকালে এই স্টেডিয়ামে ছিল ১০,০০০ দর্শককে রাখার ক্ষমতা। তবে ভুটানের ওয়াংচুক রাজবংশের শতাস্ফীর জন্য এবং জিগমে খেসার নামগিয়েল ওয়াংচুক, ভুটানের পঞ্চম রাজ্যের রাজ্যাভিষেক উৎসবের জন্য ২৫,০০০ দর্শককে স্থান দিতে এটি পুরোপুরি সংস্কার করা হয় বলে জানা যায়।



গাড়ি ছুটে চলেছে আঁকা-বাঁকা দীর্ঘ পথ ধরে। ক্রমশ উপরের দিকে উঠছে। যেতে যেতে শিলং ও দার্জিলিঙের কথা মনে পড়লো। একই রকম সাপের মত পথ পেরিয়ে গন্তব্যে যাওয়া। তবে সেখানে ছিল তিন ঘণ্টার পথ আর এখানে সাত ঘণ্টা। শুনলাম ভুটানের সর্বচ্চো পাহাড়টি ষোল হাজার ফিট। পাহাড়েও সুন্দর লুকিয়ে থাকে। সেই সুন্দরের খোঁজেই তো আমাদের এই অভিযাত্রা। সবার চোখে এখন দু’পাশের সবুজ বৃক্ষঘেরা পাহাড় আর পাহাড়, নানা প্রজাতির বৃক্ষ। মাঝে মাঝে চোখ নিচের দিকে গেলে ভয় এসে বাসা বাঁধে বুকে। তারপরও সবাই অজানা আনন্দে ছুটে চলেছি। ঘণ্টা দুয়েক যাবার পর একটি চেকপোস্ট পেলাম। সেখানে আমাদের গাড়ি থামল এবং চালক ওয়েংডি আমাদের পাসপোর্টগুলো নিয়ে গেল আর আমরা গাড়ি থেকে নেমে মুক্ত বাতাস নিলাম এবং স্বচ্ছ ঝরনার ঠান্ডা জল দু’হাত দিয়ে পান করলাম। আবার গাড়ি চলল। যেতে যেতে ওয়েংডি আবার গাড়ি থামাল। সবাই নামলাম। ও হাত দিয়ে দেখাল বিশাল একটি নদী, অনেক দূরে বয়ে চলেছে। জিজ্ঞেস করলাম কি নাম এই নদীর? জানাল, তুষারচু।



কিছু দূর যাবার পর আরেকটি নদীর দেখা পেলাম- এটির নাম পাচু। নদীগুলো পাহাড়ের মাঝখান দিয়ে বয়ে গেছে এবং খরস্রোতা। এরপর আমরা দুপুরের খাওয়ার জন্য গেদো নামক একটি জায়গায় থামলাম। এখানে ভাতের সাথে ইমাদাছি, ওমাদাছি (অর্থাৎ সবজি ও তরকারি) দিয়ে মোটামুটি পেটপুরে খেলাম। যাত্রা শুরু হলো আবার, আবারো একটি ঝরনার কাছে গাড়ি থামাল ওয়েংডি। আমরা অবগাহন করলাম পাহাড়ি নির্জনতা ও ঝরনার কলতান। কেউ কেউ ছবি ওঠালাম। অবশেষে সন্ধ্যার আলোয় সাত ঘণ্টার সড়ক পথ শেষ করে রাজধানী থিম্পু শহরে প্রবেশ করলাম। তবে শহরে ঢোকার আগে বিকেলের ঝলমলে রোদে উঁচু থেকে থিম্পু শহর দেখলাম, কখনো মনে হচ্ছিল সুইজারল্যান্ডের জুরিখ শহরকে। সবুজ পাহাড়, পাহাড়ের পাদদেশ, পাহাড়ি নদী, কলতানের ঝরনা, উপত্যকাজুড়ে বাড়ি-ঘর আর মানুষের পদচারণা- এক নান্দনিক সুর জীবনের।

ওয়েংডি তার গাড়ি শহরে প্রবেশ করিয়ে আমাদের দেখাতে লাগল- এটা, ওটা। দেখলাম ছোট্ট একটি ফ্লাইওভার, উঁচু-নিচু সড়ক পথ আর ছোট-বড় দালান-কোঠা নিয়ে ছিমছাম একটি শহর। আমরা প্রথমেই গেলাম হোটেলের খোঁজে- ওয়েংডি যে হোটেলটি আমাদের জন্য বরাদ্দ করে রেখেছিলো শহরের এক প্রান্তে, সেটি একটু পুরনো, একটু নির্জন এলাকা বলে অনেকেরই পছন্দ হলো না বলে, শহরের মূল স্থলে এসে একটি হোটেলে আমরা উঠলাম, নাম ড্রাগন হাউস। হোটেলের পাশেই Clock Tower- এটিই থিম্পুর প্রধান কেন্দ্র। খোলামেলা, টাওয়ারের নিচে বসার জায়গা রয়েছে, পাশেই সারি বেঁধে হোটেল, দোকান, রাস্তা। মানুষ আড্ডা দিচ্ছে, বাচ্চারা খেলছে- আমরাও হেঁটে বেড়ালাম, বসে আড্ডা দিলাম এবং রাতের খাবার খেয়ে হোটেলে উঠে গেলাম। হোটেলে আবার গান-বাজনার ব্যবস্থা আছে, যেখানে হোটেলের লোকজন, বাইরে থেকে আসা লোকজন এবং হোটেলের গেস্টদের নিয়ে অনেক রাত পর্যন্ত গান, নাচ, মদ খাওয়া ও ধুমধাম চলে। এটি হোটেল ব্যবস্থাপকদের একটি কৌশল অতিথি আকর্ষণ করার। (চলবে)




রাইজিংবিডি/ঢাকা/৭ এপ্রিল ২০১৮/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়