ঢাকা     শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৭ ১৪৩১

রবীন্দ্রনাথ কেনো বার বার শিলং যেতেন

তপন চক্রবর্তী || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৮:৫২, ২৪ মে ২০১৮   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
রবীন্দ্রনাথ কেনো বার বার শিলং যেতেন

তপন চক্রবর্তী: শিলং ভারতের মেঘালয় রাজ্যের রাজধানী। ইউরোপীয় শাসকেরা একে ‘প্রাচ্যের  স্কটল্যান্ড’ বলতেন। পাশ্চাত্যের স্কটল্যান্ড দেখার সুযোগ আমার হয়নি। দীর্ঘদিন ইচ্ছা ছিল। কিন্তু, ‘ঘর হতে দু’পা ফেলিয়া, দেখা হয় নাই চক্ষু মেলিয়া’। শিলং ভ্রমণের অপর এটি বড় কারণ, শিলং-এ বিশ্বকবির বাসভবন চাক্ষুষ করা। যে ভবনে বসে কবি তাঁর অমর উপন্যাস ‘শেষের কবিতা’ ও অন্যতম শ্রেষ্ঠ নাটক ‘রক্তকরবী’ লিখেছিলেন।

কৌতূহল ছিল, রবীন্দ্রনাথ কেনো বার বার শিলং যেতেন? তিনি ১৯১৯, ১৯২৩ ও ১৯২৭ সালে শিলং গিয়েছিলেন। তখন কলকাতা থেকে শিলং পর্যন্ত  কোনো বড় সড়ক ছিল না। সড়ক যেটুকু ছিল তা দিয়ে উন্নতমানের কোনো যন্ত্রযান চলতো না। ভারতীয় রেলওয়ে সেই সময় আসামের বর্তমান রাজধানী গৌহাটি পর্যন্ত রেল লাইনেরও সম্প্রসারণ ঘটায়নি। কবি সম্ভবত ব্রহ্মপুত্র নদ বেয়ে স্টীমারে গৌহাটি যেতেন। গৌহাটি থেকে দুর্গম পথে একশ কিলোমিটার রাস্তা পেরিয়ে শিলং যেতেন। অষ্টাদশ শতকে গরুর গাড়ি, পরে ঘোড়ার গাড়ি এবং বিশ শতকের গোড়ার দিকে অ্যালবিয়ন নামের যন্ত্রচালিত গাড়ি গৌহাটি থেকে শিলং যেতো।



নানা কারণে আমার স্বপ্নপূরণ হয়নি। জীবনের পড়ন্ত বেলায় ক’জন তরুণ তুর্কী শ্যামলী পরিবহণের ব্যবস্থাপনায় শিলং যাচ্ছে শুনে আমিও যাওয়ার আকাঙ্ক্ষা প্রকাশ করি। তাঁরা আমার বয়স ও দুর্বল স্বাস্থ্যের কথা মাথায় রেখেও সম্মত হন। শ্যমলী পরিবহণ পাসপোর্টে মেঘালয়ের ডাউকি সীমান্তের ভিসার ব্যবস্থা করলেও শেষ পর্যন্ত তাঁদের পরিবহণে আমাদের ঠাঁই হয়নি। আমরা আলাদা ব্যবস্থাপনায় তামাবিল হয়ে ডাউকি পৌঁছি। সিলেট পর্যন্ত রাস্তা বোধ করি খুব খারাপ ছিল না। থাকলেও রাতে ঘুমঘোরে টের পাইনি। কিন্তু সিলেট থেকে তামাবিল যাওয়ার রাস্তা এতো জঘন্য যে বর্ণনাতীত! এমনিতে বাংলাদেশের শতকরা প্রায় আশি ভাগ রাস্তা খারাপ। উন্নতমানের পাজারো জিপেও মনে হচ্ছিল দেহের হাড়গুলো আস্ত নিয়ে বোধ করি শিলং যাওয়া হবে না। সেতু ও যোগাযোগ মন্ত্রীর বাচনভঙ্গি উপভোগ্য, কথাও সুন্দর। তাৎক্ষণিকভাবে বিশ্বাসযোগ্য প্রতিশ্রুতিও দেন। কিন্তু পরিতাপের বিষয়, শেষ পর্যন্ত প্রতিশ্রুতি পূরণ করে উঠতে পারেন না। ঈদ-পূজা পর্ব বাদ দিলাম। তখন তো ‘হরিবোল’ (Horrible) অবস্থা। অন্যান্য সময়েও দেশের যানবাহনের উপর তাঁর কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। গলিগুঁজি বাদ দিয়ে অন্তত সড়কগুলো মসৃণ ও সুন্দর থাকলে তাঁকে পাশ মার্ক দেওয়া যেতো।

বাংলাদেশে প্রায় সপ্তাহখানেকের ছুটি থাকায় প্রায় চার/পাঁচ শতাধিক ভ্রমণপিয়াসী সীমান্তে জড়ো হয়েছিলেন। সেদিন অঝোরে বৃষ্টি নেমেছিল। তামাবিল বা ডাউকিতে যাত্রী স্বাচ্ছন্দ্যের জন্য কোনো অবকাঠামো গড়ে ওঠেনি। এ ছাড়া প্রায় সকল সীমান্তে বহির্গমন ও শুল্ক বিভাগের কর্তাব্যক্তিদের ‘বায়না’ মেটানো ছাড়া পাসপোর্ট বের করে আনা যে কতটা দুঃসাধ্য তা ভুক্তভোগী সবাই জানেন। কাজেই ঝাড়া দুই ঘণ্টারও বেশি বৃষ্টিতে ভিজে তামাবিল পার হয়ে ডাউকিতে আসি। সেখানকার অব্যবস্থা আরো ভীতিকর। মাত্র দুজন কর্তা তাল সামলাতে হিমশিম খাচ্ছিলেন। মনে হলো ওঁরা এই কাজে নূতন ও অনভিজ্ঞ। তবে, ভাগ্যিস, ওঁরা ‘ফেল কড়ি মাখো তেলে’ রপ্ত হয়ে ওঠেননি। আরো সৌভাগ্য, তখন বরুণ দেবতা সদয় হয়ে বর্ষণ বন্ধ করেছিলেন। বলাবাহুল্য যে, বিমানবন্দর ছাড়া অন্য সকল সীমান্তে সরাসরি বা নানা ছুতানাতায় পকেট কাটতে বাংলাদেশ ও ভারতীয় ইমিগ্রেশন ও কাস্টমস হাতপাকা করে ফেলেছে। অধিকাংশ যাত্রী তো সীমান্তে অনুসৃত আইন জানেন না। তাঁরা না জানার এই সুযোগটাই নেন। ভারত ও বাংলাদেশ সরকার মুদির দোকানে দ্রব্যের দাম টাঙানোর ব্যবস্থা করেছেন। দ্রব্যের গায়ে মূল্য উল্লেখের আইন আছে। কিন্তু সীমান্তে বিধিসমূহ বড় করে লিখে টানানোর ব্যবস্থা নেই। এই বিষয়ে দুই দেশের সরকারের কাছে ব্যবস্থা গ্রহণের অনুরোধ জানাচ্ছি।

বাংলাদেশ সরকারের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কাছে আমার জিজ্ঞাস্য, সীমান্তে কি আমাদের গোয়েন্দা নেই? ইমিগ্রেশন ও কাস্টমস-এ অনৈতিক কারবার কি তাঁরা দেখতে পান না? নাকি সর্ষের মধ্যে ভূত! দ্বিতীয়ত, বেনাপোল বা ঢাকা বিমানবন্দরে শুল্ক বিভাগে পাসপোর্ট দেখাতে হয় বটে, এর রেকর্ড রাখা বা যাত্রীর স্বাক্ষর নিয়ে পাসপোর্ট ছাড়ার কোনো নিয়ম নেই। এই ব্যাপারটি ভারতের ডাউকি সীমান্তেও লক্ষ করি। এক দেশে দুই সীমান্তে দুই নিয়ম থাকার কারণ বোধগম্য নয়। বাংলাদেশের লোকেরা এখনো সুশৃঙ্খলভাবে লাইনে দাঁড়ানোর অভ্যাস রপ্ত করেনি। সেই মানসিকতাও গড়ে ওঠেনি। ফলে কাকে ল্যাঙ মেরে কার আগে পাসপোর্ট বের করতে পারে তার জন্য দক্ষযজ্ঞ বেধে যায়। এতে অফিসারেরাও দিশা হারিয়ে ফেলেন। পাসপোর্টের সিরিয়াল ঠিক রাখা তাঁদের জন্য দুঃসাধ্য হয়ে দাঁড়ায়। অবশেষে আমাদের পাসপোর্ট উদ্ধর হতে বিকেল প্রায় পাঁচটা।



গোদের উপর বিষফোঁড়! ডাউকি থেকে শিলং যাওয়ার কার ভাড়া যেখানে দুই থেকে আড়াই হাজার রুপি, সেখানে সুযোগের অসৎ ব্যবহার করে ভাড়া ৬-৭ হাজারে দাঁড়ায়। যাঁরা এখানকার ব্যাপার-স্যাপার জানেন বা ভ্রমণে অভ্যস্ত, তাঁরা আগেই গাড়ি ও শিলংয়ে হোটেল বুক করে রওনা দিয়েছিলেন। আমরা আনাড়ির দলে। আমাদের কোনোটিই করা ছিল না। তদুপরি শেষ বেলায় কেউ যেতেও রাজি হচ্ছিলেন না। পাহাড়ি ১০০ কিলোমিটার পথ। রাতের অন্ধকারে যাওয়া ঝুঁকিপূর্ণ। আমরা প্রায় দুই কিলোমিটার দূরে ডাউকি বাজারে গিয়ে যা হোক একটা ব্যবস্থা করা যাবে স্থির করে এক ট্যাক্সিওয়ালাকে দ্বিগুণ ভাড়ায় সেখানে পৌঁছে দিতে রাজি করাই এবং মালসমেত উঠে পড়ি। বাজারে নেমে হোটেল বা গেস্ট হাউজের খোঁজ করি। সেখানেও ঠাঁই নেই। শেষাবধি এক হোটেলের গর্ভগৃহে ঠাঁই মেলে চার জনের। অন্যজন মাদুর বিছিয়ে ফ্লোরে। ভাড়া স্বাভাবিক সময়ের তিনগুণ। তবু ভালো রাতটা রাস্তায় কাটাতে হবে না! এরপর অপর এক বড় সমস্যা। এখানে কোনো মানি চেঞ্জার নেই। তামাবিলেও ছিল না। বাংলা টাকা তো এঁরা নেবেন না। খাব কী? হোটেলের ভাড়া মেটাবো কী করে? যা হোক, খবর পাওয়া গেল এক মহিলা বাংলা টাকার বদলে রুপি দেন। তাঁর দ্বারস্থ হলে তিনি যে দরে দিলেন তা প্রচলিত দরের চেয়ে অনেক কম। অবশ্য পরে দেখলাম খোদ শিলংয়ে সরকার অনুমোদিত মানি চেঞ্জার মহিলার চেয়েও কম দেন। যা হোক, এখনকার মতো মুশকিল-আসান তো হলো।

ডাউকিতে একটিই বাঙালি হোটেল। দাস হোটেল। একটা হোটেল হলে যা হয়! যা দাম হাঁকবে তাই দিতে হবে! রান্নাটা ভালো হলে তবু পুষিয়ে যেতো। রান্না ভালো করার তো ওদের কোনো দায় নেই! যা রাঁধবে তাই গিলতে হবে। পকেটের দিকে না তাকিয়ে নাক-মুখে দুটো গুঁজে ক্লান্ত দেহখানি বিছানায় সঁপে দেই। আমার তো জীর্ণ তরী। অশ্বমেধের ঘোড়া ডাক্তার গৌতম, অধ্যাপক সুব্রত, শেখর কবরেজ ও সমাজসেবী গণেশ কাকু- জ্যেঠুরা যেনো আমার চেয়েও ক্লান্ত বিধ্বস্ত।



পরদিন সকালে চেরাপুঞ্জি হয়ে শিলং শহরের উদ্দেশ্যে রওনা দেই। ডাউকি সেতু পার হয়ে চেরাপুঞ্জির পথে যাত্রা শুরুতে গত দিন ও রাতের সকল ধকল, কষ্ট ও বিড়ম্বনা এক মুহূর্তে উবে যায়। যেদিকে চোখ যায় সেদিকে পাহাড়ের পরে পাহাড়, তাতে জমে থাকা মেঘের পরে মেঘ, আর শ্যামলী নিসর্গের অফুরন্ত ভাণ্ডার। প্রকৃতির এই অপার অকৃত্রিম দান গ্রহণের জন্য যে মানসিক প্রস্তুতি থাকা আবশ্যক তা সবার থাকে না। আমারও ছিল না। হঠাৎ যক্ষের ধন পেলে সাধারণ মানুষ যেমন দিশেহারা হয়ে পড়ে, আমার অবস্থার সঙ্গে তার মিল খুঁজে পাই। আমি মুদ্ধ চোখে পাতা না ফেলে কেবল চেয়েই থাকি। অবিরাম একই দৃশ্যে ক্লান্তি আসা স্বাভাবিক। কিন্তু এখানকার দৃশ্য মুহূর্তে মুহূর্তে পাল্টে যায়। নিসর্গের প্রেক্ষাপটে অদৃশ্য কুশীলবেরা যেনো নীরবে নব নব সাজে প্রকৃতির রঙ্গমঞ্চে ধোঁয়াশার সৃষ্টি করে চলে।

শিলং-কন্যা প্রখ্যাত সমাজকর্মী ও কবি অঞ্জলি লাহিড়ীর ‘অনন্ত যাত্রী আমি’ কাব্যগ্রন্থের ‘মেঘালয়’ কবিতায় মেঘালয়ের বর্ণনা দিয়েছেন এইভাবে:

                   মেঘালয়ের আকাশ জুড়ে

                                নীলাম্বরী মেঘ

                   কোথা থেকে পায় সে ছাড়া সে

                                কোথায় ছুটে যায়

                   কেউ কি জানে ঠিকানা তার

                                 কেউ কি জানে হায়!

                    হঠাৎ নামে বৃষ্টিধারা

                    আকাশ ভেঙে পড়ে

                    তুলোর মতো নীল কুয়াশা

                                    সৃষ্টি আঁধার করে।

                    পাহাড় থেকে ঝর্না নামে

                     শব্দে উতরোল

                     তরতরিয়ে পথ কেটে যায়

                     তরঙ্গ হিল্লোল।...

(চলবে)


 


রাইজিংবিডি/ঢাকা/২৪ মে ২০১৮/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়