ঢাকা     মঙ্গলবার   ২৩ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১০ ১৪৩১

পাহাড়ে অসুস্থতার ঝুঁকি যেখান থেকে শুরু

ইকরামুল হাসান শাকিল || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১১:২৮, ১৯ জানুয়ারি ২০১৯   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
পাহাড়ে অসুস্থতার ঝুঁকি যেখান থেকে শুরু

চা বিরতির পর সির্দ্ধিবাস থেকে আবার হাঁটা শুরু হলো। উপর থেকে পাহাড়ের ঢাল বেয়ে নিচে নেমে এলাম একদম বুড়িগন্ধকীর পাড়ে। সমতল সবুজ একটি মাঠ পেড়িয়ে এলাম পাইন বনের ভিতর দিয়ে। মাঠ শেষে বুড়িগন্ধাকীর উপরে নির্মিত এ অঞ্চলের সবচেয়ে বড় সাসপেনশন ব্রিজ পার হলাম। তারপর বিশাল এক চড়াইয়ে উঠে চলে এলাম ছবির মতো সুন্দর ফিলিমে। এই গ্রামটি অসাধারণ সুন্দর! আজকের দুপুরের খাবার এখানে খেতে হবে। তবে আনন্দের বিষয় আজ এখানে মুরগির মাংস পাওয়া যাবে। খুব ক্ষুধাও লেগেছে। তাই পাগলের মতো খাবার খেয়ে আবার বেরিয়ে পড়লাম। আজ আরো অনেকটা পথ যেতে হবে। তাই খাবার শেষে বিশ্রাম নেয়া হলো না। পাহাড়ের গা ঘেঁষে এঁকেবেঁকে এগিয়ে চলেছি।

আগেই বলেছি আজকের গন্তব্য ড্যাং। এদিকে ক্লান্ত সূর্যও জানান দিচ্ছে আর বেশি সময় নেই। খুব দ্রুত রাতের অন্ধকার চারপাশ ঢেকে দেবে। আবার অন্যদিকে ড্যাং-এ মাত্র দুটি লজ আছে। খোঁজ নিয়ে জানা গেলো সেখানে আজ ট্রেকারদের অনেক ভিড়। ফলে থাকার জায়গা পাওয়া যাবে না। একমাত্র তাঁবু লাগালেই থাকা যাবে। তবে আমাদের সঙ্গে তাঁবু নেই। তাঁবু সামাগাঁও রয়ে গেছে। রাতে থাকার বিষয়ে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেয়া হলো। সামনে পেওয়া নামক একটি জায়গা আছে। সেখানে একটি লজ আছে। যদি রুম পাওয়া যায় তাহলে সেখানেই আজ থেকে যাব। সন্ধ্যার আগেই আমরা পেওয়া এসে পৌঁছলাম। ড্যাংয়ের ৪৫ মিনিট আগে পেওয়া। লজে থাকার জায়গাও পেয়ে গেলাম। এই লজে থাকা-খাওয়ার ভালো ব্যবস্থা আছে। লজের পাশ দিয়েই বুড়িগন্ধাকী বয়ে চলেছে। তার গর্জনে কান পাতা দায়। এরকম এক জায়গায় দিনের পর দিন কাটিয়ে দেয়া যায় অকারণেই।

 



খুব ভোরেই ঘুম থেকে উঠতে হলো। যেহেতু এখানে বেশ শীত, সেহেতু ভোরে উষ্ণ কম্বলের ভিতর থেকে বের হতে একটু কষ্টই হচ্ছিলো। মন চাচ্ছিলো আর একটু শুয়ে থাকি। কিন্তু সে জো নেই। আজ যেতে হবে নামরুং। পথটাও বেশ লম্বা। তার উপর প্রায় ৪৫ মিনিটের পথ আগেই  গতকাল থেমেছি। আজ সেটুকুও পাড়ি দিতে হবে। ফলে আলস্যকে কোনো অবস্থাতেই পাত্তা দেয়া গেলো না। ড্যাং এসে আমরা চা বিরতি দিলাম। এই ড্যাং গ্রামটি বেশ ছোট। বিরতি শেষ করে আবার হাঁটা শুরু। গ্রাম পার করে এসে সোজা নেমে আসতে হলো একদম বুড়িগন্ধাকীর পাড়ে। একটি সাসপেনশন ব্রিজ পার হয়ে শুরু হলো আকাশ ছোঁয়া চড়াই। এই চড়াই শেষ হবে কোথায় গিয়ে কে জানে?

কঠিন খাড়া চড়াই উঠছি। অনেকটা কচ্ছপ গতিতে ধীরে ধীরে। এই চড়াই উঠতে প্রায় ঘণ্টাখানেক সময় লেগে গেলো আমাদের। একটু পানি পানের বিরতি দিয়ে আবার এগিয়ে চলা। ঘন জঙ্গলের ভিতর দিয়ে ট্রেকিং করছি। একটা জায়গায় গাছে আপেল দেখে খাওয়ার লোভ সামলাতে পারলাম না। টাটকা আপেল কেনা হলো। আপেল খেয়ে আবারও চলা। অপেক্ষাকৃত নিচু অঞ্চলের গাছগাছালি এখন আর নেই। জায়গায় জায়গায় পাইন গাছ চোখে পড়ছে। পাহাড়ি ঢাল ধরে আমরা চলেছি। চলার পথে একটু দূরে দূরে দুটি বসতবাড়ি চোখে পড়লো। পাশে এক চিলতে জমিতে যব অথবা ভুট্টার চাষ হচ্ছে। এই অঞ্চলের ফসল বলতে যব, ভুট্টাই প্রধান।

 



ভিজাম নামক একটি জায়গায় চলে এলাম। এটি ছোট্ট গ্রাম। হাতে গোনা কয়েকটি বাড়ি। এখানে লজ বলতে মাত্র একটি । এখানেই আজকের দুপুরের খাবার বিরতি। লজের মালি বেশ খাতির করে আমাদের বসালেন। মুহিত ভাই, নুর ভাই ও বিপ্লব ভাই দাড়ি-গোঁফ কামানোর কাজে লেগে গেলেন। এখানে ছোট্ট ছোট্ট তিন-চারজন বাচ্চাও পেয়ে গেলাম। আমি ও বিথী তাদের সঙ্গে ফুটবল খেলা শুরু করে দিলাম। গৃহকর্তা আমাদের বাংলাদেশি পরিচয় শুনে নেপালি স্টাইলে না রেঁধে একেবারে আমাদের বাংলাদেশের মতো করে ঘন ডাল রেঁধেছেন। পরে জানতে পারলাম তিনি  মালয়েশিয়ায় প্রবাসী জীবন কাটিয়েছেন। তখন বাংলাদেশিদের সঙ্গে থাকার ফলে আমাদের খাদ্যাভ্যাস ভালোই জানা হয়েছে তার।

খাবার শেষ করেই আবার এগিয়ে চলেছি। আজকের পথটা যেমন লম্বা তেমনি চড়াই উৎরাইও বেশি। বিকেলের দিকে আমরা গ্যাপ নামক এক জায়গায় এসে পৌঁছালাম। এখানেই কিছু সময় জিরিয়েই নামরুং এর দিকে চলা শুরু হলো। এখান থেকেই জানতে পারলাম নামরুং আরো প্রায় আড়াই-তিন কিলোমিটার দূরের পথ। গভীর ও ঘন বনের ভিতরে ঢুকে গেলাম। বন দেখে মনে হচ্ছে রেইন ফরেস্ট। এদিকে আর জনপদ চোখে পড়লো না। দেখতে দেখতে বিকেল ঘনিয়ে সন্ধ্যা নেমে এলো। আমরাও দ্রুত পায়ে এগিয়ে চলেছি। শরীরও এখন আর চলতে চাচ্ছে না। সেই ভোর থেকে সন্ধ্যা হয়ে গেলো হাঁটছি কিন্তু পথ শেষ হচ্ছে না। এদিকে ঠান্ডা বাড়ছে। দাঁড়ালেই শরীরে কাঁপুনি দিয়ে ওঠে শীত। তারপরও হাঁটার গতি বাড়িয়ে হাঁটতে হচ্ছে।

 



এক সময় জঙ্গলের সমতল অংশ শেষ করে আমরা পাহাড়ের খাড়া চড়াইয়ে উঠতে শুরু করলাম। তখনও জানি না এর শেষ কোথায়? এদিকে চারপাশ অন্ধকার হয়ে আসছে। একেবারে জান বের করে দেয়া চড়াই। আমাদের আজ রাতের আবাস নামরুং। জায়গাটির উচ্চতা ২ হাজার ৬৩০ মিটার। অল্টিচিউড সিকনেস হওয়ার ঝুঁকি সাধারণত এই উচ্চতা থেকেই শুরু হয়। বিশ্রাম না নিয়ে একটানা উঠেই যাচ্ছি। একটি মাইল ফলক পেলাম সেখানে লেখা থেকে জানতে পারলাম এখান থেকে নামরুংয়ের দূরত্ব আরও প্রায় পঁয়তাল্লিশ মিনিটের পথ।  সবাই ব্যাগপ্যাক থেকে হেড লাইট বের করে প্রস্তুত হয়ে নিলাম। বনপথ কিন্তু এখনও শেষ হয়নি। হেড লাইটের আলোয় এগিয়ে চলেছি। আমরা বুঝতে পারছিলাম মেঘ আমাদের ছুঁয়ে দিয়ে যাচ্ছে। অবশ্য এই উচ্চতায় এটিই স্বাভাবিক। আমাদের গাইড জয় মাল্লা লজ ঠিক করতে আগেই চলে গেছেন নামরুং। আমাদের সঙ্গে তাশি আছে। মাল্লা লজ ঠিক করে আবার ফিরে এসেছে আমাদের এগিয়ে নিতে। অবশেষে টানা এগারো ঘণ্টা ট্রেকিং শেষে আমরা নামরুংয়ে পৌঁছলাম। নামরুংয়ের আলো ঝলমলে সাজসজ্জার লজ দেখে আমরা অবাক! তবে টানা এগারো ঘণ্টা চড়াই-উৎরাই পথ পারি দেয়ার ধকল শরীরজুড়ে। তাই দ্রুত ডিনার করে কম্বলের উষ্ণ অভ্যর্থনায় গা এলিয়ে দিলাম। (চলবে)

ছবি: কাজী বিপ্লব



রাইজিংবিডি/ঢাকা/১৯ জানুয়ারি ২০১৯/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়