ঢাকা     শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৭ ১৪৩১

ভুল করলেই মৃত্যু

ইকরামুল হাসান শাকিল || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৭:৪৬, ৭ ফেব্রুয়ারি ২০১৯   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
ভুল করলেই মৃত্যু

কখনো এক পাথর থেকে আরেক পাথরে লাফিয়ে, কখনো বড় বড় পাথরের বোল্ডারের ফাঁক দিয়ে এগিয়ে চলছি। মাল্লা ও নিমা শেরপা আগে চলে গেলেন। তারা হাইক্যাম্পের উপরে একটি খাড়া দেয়াল আছে। সেখানে রোপ ফিক্স করতে এবং সামিটের রোড ওপেন করতে হবে। আমাদের সঙ্গে আছে তাশি শেরপা। সবার আগে তাশি, তাকে অনুসরণ করে মুহিত ভাই, বিথী, আমি, নুর ভাই এবং বিপ্লব ভাই এগিয়ে চলছি। হঠাৎ পেছনে বিপ্লব ভাইয়ের চিৎকার শোনা গেল। নুর ভাই যে আলগা পাথরের বোল্ডারে পা রেখেছেন সেটা গড়িয়ে বিপ্লবের দিকে আসছে। অল্পের জন্য তারা দু’জনই রক্ষা পেলেন। খুবই সাবধানে আমাদের পা রাখতে হচ্ছে পাথরের বোল্ডারের উপরে। গ্লেসিয়ার পার হয়ে এখন চড়াই শুরু। প্রায় ঘণ্টাখানেক সময় পর চলে এলাম ক্র্যাম্পন পয়েন্টে। এখানে এসে আমরা হার্নেস আইস বুট ও ক্র্যাম্পন পরে নিলাম। উপরে যাওয়ার জন্য এখানে প্রস্তুতি ও একটু বিশ্রাম নেয়ায় কিছু সময় ব্যয় হয়ে গেলো। এমন সময় নজরে এলো কালকের সেই একই জায়গা থেকে আবার মেঘ জমা হচ্ছে। দেখতে দেখতে সেই মেঘ চারপাশ ঢেকে দিলো।

এখান থেকে আমরা মেইন রোপে আরোহণ শুরু করছি। মেইন রোপ বলতে সবাই একই দড়িতে বাঁধা থাকবো। প্রথমে আমাদের সঙ্গে থাকা গাইড তাশি শেরপা তারপর মুহিত ভাই, বিথী, আমি, নুর ভাই ও সবার শেষে বিপ্লব ভাই। এদিকে প্রচণ্ড তুষার ঝড় শুরু হয়ে গেছে। তাপমাত্রা নেমে গেছে শূন্যেরও পনেরো ডিগ্রি নিচে। বরফের ভিতরে হাঁটু পর্যন্ত পা ঢুকে যাচ্ছে। খাড়া ঢাল হওয়াতে উপরে উঠতে খুবই বেগ পেতে হচ্ছে। দুই পা সামনে গেলে আবার প্রায় ঠিক ততটুকুই নিচের দিকে নেমে আসি। এর কারণ পায়ের নিচ থেকে আলগা বরফ সরে যাওয়া। এদিকে সোঁজা হয়ে দাঁড়িয়েও থাকা যাচ্ছে না। বাতাসের গতি এতই বেড়ে গেছে যে, মনে হচ্ছে উড়িয়ে নিয়ে যাবে। তুষারপাতের কারণে চারপাশ হোয়াইট আউট হয়ে গেছে। পেছনে তাকিয়ে দেখি বিপ্লব ভাইকেও দেখা যাচ্ছে না। এতটাই তুষারপাত হচ্ছে। আমরা ধীরে ধীরে এগিয়ে চলছি অনিশ্চয়তার পথে।
 


কিছুটা সমতল জায়গায় এসে দাঁড়ালাম। পাশেই পাথরের দেয়াল। উপর থেকে পাথরের ছোট ছোট টুকরো পড়ছে। তাই এখানে বেশি সময় দাঁড়ালাম না। সেই সকালে খাবার খেয়েছিলাম ম্যাকারনি। ক্ষুধায় পেটের ভিতরে যুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে। শরীরটাও বেশ ক্লান্ত। গাইড আমাদের সতর্ক করে দিলেন এই বলে, এখন আমরা যে জায়গা দিয়ে যাবো সেই পথটায় অনেকগুলো ক্রেভার্স আছে। গতকাল যখন তারা এসেছিলেন হাইক্যাম্প তৈরি করতে তখন এই ক্রেভার্সগুলো দেখে গেছেন। কিন্তু আজ তুষারপাত হওয়ায় ক্রেভার্সের অনেকগুলোই ঢেকে গেছে। তাই বুঝা যাচ্ছে না কোথায় ক্রেভার্স আছে কি নেই। এই পথটুকু ভীষণ বিপজ্জনক।খুব সাবধানে মেইন রোপে ধীরে ধীরে কচ্ছপের মতো এগিয়ে চলছি। এদিকে ঠান্ডায় জমে যাচ্ছি। চারপাশ কাঁপিয়ে বিকট শব্দে পাশের একটি পাহাড়ের তুষার ধ্বস নেমে এলো। হোয়াইট আউটের কারণে দেখতে পেলাম না, তবে শব্দ শুনে বুঝতে পারলাম বেশি দূরে হবে না। গাইড তাশি চিৎকার করে সতর্ক করলেন। আমরা যে পথে যাচ্ছি এটাও তুষারধ্বস এলাকা। হাইক্যাম্পে যাওয়ার শেষ চড়াই একটু বাঁক খাওয়ানো। ঠিক বাঁকের এখানেই বড় একটি বরফের ক্রেভার্স বা ফাঁটল। এই পথটায় ফিক্সড রোপ লাগানো হয়েছে। এখানে পাথরের বোল্ডার বেশি তাই পথটা আরো ভয়ঙ্কর হয়েছে। আমরা একজন একজন করে পথটা উঠে এলাম। তখন ঘড়ির কাটা বিকেল চারটের ঘর অতিক্রম করেছে।

এদিকে মাল্লা ও নিমাও উপর থেকে নেমে এসেছে। গাইডরা এখানে ছোট একটি জায়গার মধ্যে বরফ সরিয়ে তিনটি তাঁবু লাগালেন। একটি তাঁবু গাইডদের জন্য আর বাকি দুইটা আমাদের পাঁচজনের জন্য। হাইক্যাম্পের তিন পাশেই উঁচু বরফ আর পাথরের দেয়াল। যে জায়গায় আমাদের তাঁবু লাগানো হয়েছে সেখানেও অনেকগুলো ক্রেভার্স। তাঁবুর সামনে ও পেছনে বড় দুটি ক্রেভার্স। তাঁবুর মুখ থেকেই ক্রেভার্সেও ঢালু। ভয়ঙ্কর রকমের ঝুঁকিপূর্ণ জায়গায় এই ক্যাম্প। আশপাশে এরচেয়ে ভালো জায়গাও নেই যে সেখানে ক্যাম্প করবে। বাতাস কিছুটা কমলেও তুষারপাত ও হোয়াইট আউট কমেনি। আমরা সবাই তাঁবুর ভিতর ঢুকে গেলাম। আমরা সবাই ডাউন জ্যাকেটের উপরে উইন্ড জ্যাকেটও পরেছি। কিন্তু নুর ভাই উইন্ড জ্যাকেট পরেনি। তাই তার শরীর অসার হয়ে যাচ্ছিলো। আমি আর বিপ্লব ভাই নুর ভাইকে জড়িয়ে ধরে বসে রইলাম আর শরীর ম্যাসেজ করতে লাগলাম। সারাদিন পেটে তেমন কিছু পরেনি। ক্ষুধায় শরীর কাঁপতে শুরু করেছে। তাশি শেরপা আমাদের তাঁবুতে গরম নুডলস মগে করে দিয়ে এলেন। সরাদিন পর এই একটু নুডলস যেন অমৃত! নামে মাত্র নুডলস, মগ ভর্তি শুধু পানি। চকলেট, খুরমা খেজুর, কিসমিস আর চিপস খেয়ে পেটের ক্ষুধা নিবারণ করলাম। আজ রাতেই যেহেতু সামিট পুশ সেহেতু অতিরিক্ত কিছু সাথে আনা হয়নি এমন কি খাবারও। মাল্লা এবং নিমা আমাদের তাঁবুতে এসে উপরের অবস্থার কথা জানালেন। তাদের কথায় জানতে পারলাম উপরের অবস্থা তেমন ভালো না। তারা হাইক্যাম্পের পরের যে খাড়া দেয়াল সেটার উপর পর্যন্ত দড়ি বেঁধেছে। যখন তারা রোড ওপেন করেন তখন বাতাসের গতি অনেক বেশি ছিলো। তুষারপাতও হয়েছে অনেক, একদম হাঁটুর উপর পর্যন্ত। তুষার ধ্বস হতে পারে যে কোনো সময়। তাই রাত ২টার মধ্যই সামিট পুশ করার সিদ্ধান্ত নেয়া হলো।
 


সবাই ভীষণ ক্লান্ত। অন্যদিকে মাঝরাতেই সামিট পুশ তাই দ্রুত রাতের খাবার খেয়ে ঘুমাতে হবে। রাতের খাবার ম্যাকারনি। যদিও ম্যাকারনি রাতের খাবারে যথেষ্ট নয়। তারপরও এইটুকু খাবারই খেতে হবে। এখন আবার বাতাসের গতি বাড়তে শুরু করলো। সাথে তুষারপাত। তাঁবু প্রায় অর্ধেক তুষারের মধ্যে ঢুকে গেছে। এমন সময় আমার প্রকৃতির ডাক পেলো। বাইরে হচ্ছে তুষার ঝড়। মনে হচ্ছে তাঁবুসহ আমাদের নিয়ে ফেলবে সামনে অথবা পিছনের ক্রেভার্সে। প্রকৃতির ডাক আবার সেসব বুঝে না। তাই আর বসে থাকা সম্ভব হলো না। তাঁবুর জিপার খুলে বরফ সরিয়ে বের হলাম। বাইরে প্রচন্ড তুষার ঝড়। তাঁবুর দড়ি ধরে দুই তাঁবুর মাঝখানে বরফ সরিয়ে কাজ সেরে নিলাম। চারপাশে মেঘের কুণ্ডলী জমে আছে। দ্রুত তাঁবুর ভিতরে ঢুকে গেলাম। এখন তাপমাত্রা হিমাংকের বিশ ডিগ্রির নিচে চলে এসেছে। পাশের পাহাড় থেকে থেমে থেমে রক ফল হচ্ছে। পাথরের ছোট ছোট টুকরো আমাদের তাঁবুতে এসে লাগছে। বাতাসের কারণে এক তাঁবু থেকে আরেক তাঁবুতে কথা শোনা যাচ্ছে না। তাই মাল্লা এসে আমাদের হেলমেট পরে থাকতে বললো। আমরা হেলমেট পরে হেডটর্চের আলো জ্বেলে আবহাওয়া ভালো হওয়ার অপেক্ষা করতে লাগলাম। আমাদের সবার চোখেই এক অনিশ্চয়তার আতঙ্ক। এখন সময়টাও যেন অলস গতিতে এগিয়ে চলছে। এদিকে বেসক্যাম্পে সানভি ভাই ও একজন পোর্টার আছে। সেখানে কি তাণ্ডব চলছে ঝড়ের কে জানে। তারমধ্যে এটাই সানভি ভাইয়ের প্রথম অভিজ্ঞতা। ভয় থেকে নিজেকে সামলাতে পারছে কিনা সেটা নিয়েও আমাদের চিন্তা হচ্ছে।

রাত ১২ টার দিকে তুষার ঝড় থামলো। মনে হলো আমরা দম ফিরে পেলাম। আমরা মানসিকভাবে প্রস্তুতি নিতে শুরু করে দিলাম। আগেই সিদ্ধান্ত হয়েছিলো রাত ২টার দিকে সামিট পুশ হবে। এখনো প্রায় দুই ঘণ্টা সময় আছে আমাদের। এই সময়টা আমার চা, বিস্কুট, খেজুর, কিসমিস ও নুডলস খেয়ে শরীরে কিছুটা শক্তি সঞ্চয় করে নিচ্ছি। মনের ভিতরে উত্তেজনা কাজ করতে লাগলো। উপরে আমাদের জন্য কি অপেক্ষা করছে তা জানা নেই। তারপরও উপরে যাওয়ার এক ভয়ংকর টান আমাদের টানছে। যে টান মৃত্যুকেও উপেক্ষা করে। আমরা সবাই প্রস্তুত। যেহেতু অনেক তুষারপাত হয়েছে এবং আবহাওয়া তার বহুরূপি রূপ দেখাচ্ছে সেহেতু আমাদের একটু বেশিই সতর্কতার সাথে প্রস্তুতি নিতে হলো। নূন্যতম ভুল করা যাবে না। তাই একে অপরের প্রস্তুতির সকল বিষয়ে খোঁজ নিচ্ছি। বিপ্লব ভাই বলেই ফেললেন, ‘আমরা এখন যুদ্ধে যাচ্ছি কোন ভুল করা চলবে না। মুক্তিযুদ্ধের সময় ঠিক এভাবেই প্রস্তুতি নিতো মুক্তিযোদ্ধারা আক্রমণে যাওয়ার আগে।’ হ্যাঁ, তাই। আমরা আজ এখানে আছি এই লাল-সবুজের পতাকার জন্যই। যে পতাকার জন্য মৃত্যুকে উপেক্ষা করে মুক্তিযোদ্ধারা যুদ্ধ করেছেন। সেই  পতাকার জন্যই আমরাও মৃত্যুকে উপেক্ষা করছি। মাল্লা এসে আমাদের জানালো আবহাওয়া আবারো খারাপ হতে শুরু করেছে।
 


মুহিত ভাই, বিপ্লব ভাই আর নুর ভাই তাঁবু থেকে বের হলেন। দেখলেন নিচের দিক থেকে মেঘ অন্ধকার করে আসছে। তারপর দাফায় দফায় বেশ কয়েকবার আলোচনায় বসা হলো আমরা কি উপরে যাবো কি যাবো না? দলনেতা দেশসেরা এবং সবচেয়ে অভিজ্ঞ পর্বতারোহী এম এ মুহিত ভাই, অভিজ্ঞ দুই পর্বতারোহী নুর ভাই, বিপ্লব ভাই, বিথী ও আমাকে নিয়েও আলোচনা করলেন। আমাদের সবার মতামত নিলেন। শেরপা গাইডরা জানালেন উপরের অবস্থা এখন বিপজ্জনক। আবহাওয়া খারাপ হয়ে আসছে। প্রচণ্ড তুষারপাতের ফলে অ্যাভালান্সের ঝুঁকি খুবই বেশি। আর হাঁটুর উপর পর্যন্ত বরফ জমে আছে। তাই জীবনের ঝুঁকির কথা চিন্তা করে তারা উপরে না যাওয়ার পরামর্শ দিলেন। সকল পরিস্থিতি বিবেচনা করে এবং সকলের নিরাপত্তার কথা ভেবে রাত তিনটের সময় সামিট পুশ স্থগিত করা হলো। (চলবে)




রাইজিংবিডি/ঢাকা/৭ ফেব্রুয়ারি ২০১৯/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়