ঢাকা     শুক্রবার   ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৬ ১৪৩১

মণ্ডা খেতে মুক্তাগাছা

গাজী মুনছুর আজিজ || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৮:২৬, ২৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৯   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
মণ্ডা খেতে মুক্তাগাছা

গাজী মুনছুর আজিজ: স্বাদের জন্য মুক্তাগাছার মণ্ডার সুনাম দেশব্যাপী। গোপাল পাল এই মণ্ডার আবিষ্কারক। তিনি ১৮২৪ সালে মণ্ডার দোকান প্রতিষ্ঠা করেন। এরপর প্রায় ২০০ বছর ধরে মণ্ডার ব্যবসা করে আসছেন তারই বংশধররা। বঙ্গবন্ধুসহ দেশ-বিদেশের অনেক খ্যাতিমান তার দোকানে মণ্ডা খেয়েছেন। সেই মণ্ডার খোঁজে ময়মনসিংহের মুক্তাগাছা যখন পৌঁছাই তখন প্রায় শেষ বিকেল। কর্মচারীরা দোকানের ফ্লোর মোছার কাজে ব্যস্ত। মোছা শেষ হলে গিয়ে বসি চেয়ারে। একজনকে মণ্ডা দিতে বললে তিনি উল্টো জিজ্ঞাসা করলেন- কোনটা খাবেন? বললাম কয় প্রকার আছে? তিনি বললেন,দুই প্রকার। খেজুর গুড়ের, আর চিনির। বললাম দুটোই দিন। চাওয়া মাত্র মণ্ডা চলে এল স্টিলের প্লেটে। সঙ্গে স্টিলের চা-চামচ।

গোল ও চ্যাপ্টা মণ্ডা অনেকটা ছোট রসগোল্লা আকারের। কিংবা পেঁড়া বা পেঁড়া সন্দেশের মতো। প্রতিটির ওজন ৫০ গ্রাম। খেজুর গুড়েরটা খয়েরি রঙের। চিনিরটা সাদা। প্রথমেই মুখে দেই গুড়েরটা। সত্যিই অসাধারণ স্বাদ! এর আগে মণ্ডা নামে যা খেয়েছি তা এর কাছে পানসে মনে হলো। দোকানি জানালেন, গুড়েরটা শুধু শীতকালে পাওয়া যায়। চিনিরটা সারা বছরই থাকে। গুড়েরটা প্রতিটি ৩০ আর চিনিরটা ২৫ টাকা।



দোকানে ঢুকতেই বাঁ পাশে ক্যাশ কাউন্টার। সামনে ও ডান পাশে সাজানো কাঠের চেয়ার ও ছোট ছোট কাঠের টেবিল। এসব চেয়ারে আমার মতো আরও অনেকেই বসে মণ্ডা খাচ্ছেন। দোকানের দেয়ালে সাঁটানো প্রতিষ্ঠাতাসহ মণ্ডার নানা কথা।

খাওয়া শেষ করে ক্যাশ কাউন্টারে বিল দিতে গিয়ে দোকানি মিহির কুমার পালকে বলি, শুধু মণ্ডা খেতেই ঢাকা থেকে এখানে আসা। শুনে তিনি বললেন-আমাদের মণ্ডা খেতে ঢাকাসহ দেশের নানা প্রান্ত থেকে প্রতিদিনই অনেক মানুষ আসেন। খেয়ে তারা তৃপ্তিও প্রকাশ করেন। মণ্ডা ও তার আবিষ্কারকের কথা জানতে চাইলে মিহির কুমার পাল আমার হাতে একটি পুস্তিকা ধরিয়ে দিয়ে বললেন, বইয়ে সব আছে। বললাম আপনার মুখ থেকে একটু শুনতে চাই। তিনি বললেন, মণ্ডার আবিষ্কারক আমাদের পূর্বপুরুষ গোপাল পাল (তার পূর্ণ নাম রাম গোপাল পাল)। জন্ম ১৭৯৯ সালে। মৃত্যু ১৯০৭ সালে। বর্তমানে পঞ্চম পুরুষের ব্যবসা চলছে। এখন এর পরিচালক রবীন্দ্রনাথ পাল। স্বাদের জন্যই এই মণ্ডার সুনাম দেশব্যাপী। এটি তৈরির পদ্ধতি একান্তই আমাদের পারিবারিক ও গোপনীয়। আমরা ছাড়া মণ্ডা তৈরির কৌশল আর কেউ জানেন না। ফলে অন্য যে কোনও মণ্ডার সঙ্গে আমাদের মণ্ডার মিল পাওয়া যাবে না। আর সে কারণেই এ দোকান ছাড়া ময়মনসিংহ, ঢাকাসহ দেশের অন্য কোথাও আমাদের মণ্ডার শোরুম, এজেন্ট, ডিলার, বিক্রয় কেন্দ্র বা বিক্রয় প্রতিনিধি নেই। সেজন্য গোপাল পালের প্রসিদ্ধ, আদি ও অকৃতিম মণ্ডা খেতে হলে মুক্তাগাছার এই দোকানেই আসতে হবে।



মিহির কুমার পালের দেয়া পুস্তিকার তথ্য অনুযায়ী- গোপাল পাল মণ্ডা তৈরি করে প্রথমে খাইয়েছেন মুক্তাগাছার মহারাজা বাবু সূর্যকান্ত আচার্য চৌধুরীকে। মহারাজা খেয়ে খুব প্রশংসা করেন। মহারাজার পাশাপাশি অন্য রাজা ও জমিদাররাও খেয়ে প্রশংসা করেন। এরপর থেকে মুক্তাগাছার রাজা বা জমিদারদের বাড়িতে অন্য রাজ্যের বা দেশের রাজা-বাদশারা এলে তাদের আপ্যায়নে থাকতো মণ্ডা। খেয়ে তারাও প্রশংসা করেন। এছাড়া মুক্তাগাছার রাজা বা জমিদাররা কোথাও বেড়াতে গেলে উপহার হিসেবে এই দোকানের মণ্ডা নিয়ে যেতেন। সুর সম্রাট ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ, চিকিৎসক বিধানচন্দ্র রায় (তিনি পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন), নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসুসহ অনেক খ্যাতিমানরা খেয়েছেন এই মণ্ডা। সূর্যকান্ত মহারাজার ছেলে শশীকান্ত আচার্য চৌধুরী একবার রাশিয়ার নেতা স্টালিনকে এখান থেকে সংগ্রহ করে মণ্ডা পাঠান। তিনিও খেয়ে প্রশংসাপত্র পাঠিয়েছিলেন। এভাবে গোপাল পালের জীবদ্দশাতেই মণ্ডার খ্যাতি ছড়িয়ে পরে ভারতীয় উপমহাদেশসহ বিভিন্ন দেশে। ব্রিটেনের রানী এলিজাবেথ, ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী, পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান, পূর্ব পাকিস্তানের গভর্ণর মোনায়েম খান, মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, জিয়াউর রহমানসহ আরও অনেক খ্যাতিমান এই মণ্ডা খেয়ে প্রশংসা করেছেন। মণ্ডা তৈরির পদ্ধতি গোপাল পাল স্বপ্নে পেয়েছেন সে কথাও উল্লেখ আছে পুস্তিকাটিতে।



আরও কিছু কথা শুনি মিহির কুমার পালের কাছে। এরপর কিছু মণ্ডা কিনে বের হই দোকান থেকে। হেঁটে আসি মুক্তাগাছা শহরে। অটো রিকশায় আসি নতুন বাজার। এ বাজারে সাপ্তাহিক হাট বসেছে। পথের পাশে হাট। হাটের একপাশে উঠেছে গরু-ছাগল। অন্যপাশে আছে চিড়া, মুড়ি, মোয়া, নাড়ু- জিলাপি, মিষ্টিসহ নানা ধরনের দেশীয় খাবার। আরও আছে- পেঁয়াজ, রসুনসহ বিভিন্ন মশলা, শাকসবজি, বাশ-বেতের পণ্য ইত্যাদি। হাটের একপাশে ছোট ছোট ঝুড়ি ও সিলভারের বলে নিজের গাছের কলা, বেল, পেঁপে, লেবু, মরিচ ইত্যাদি নিয়ে বসেছেন অনেক কৃষক ও গেরস্থ। কিছুক্ষণ ঘুরে হাট দেখি। হাটের একপাশে বড় বট গাছের নিচে চায়ের দোকান। সে দোকানে খাই র-চা। তারপর ধরি ঢাকার পথ।

ছবি : লেখক




রাইজিংবিডি/ঢাকা/২৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৯/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়