ঢাকা     শুক্রবার   ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৬ ১৪৩১

নয়নাভিরাম ‘সুইসাইড পয়েন্ট’

ইয়াসিন হাসান || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০২:৩২, ১৭ জুন ২০১৯   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
নয়নাভিরাম ‘সুইসাইড পয়েন্ট’

ইয়াসিন হাসান, ইংল্যান্ড থেকে: অপঘাতে কারো মৃত্যু হলে সেই মৃত আত্মা নাকি মুক্তি পায় না৷ অতৃপ্ত আত্মা হিসেবে সেই স্থানের আশপাশে ঘুরে বেড়ায়। জেনে কিংবা না জেনে মানুষের ক্ষতি করে অতৃপ্ত আত্মা। ভূত-প্রেত হয়ে বারবার আসে সামনে। কখনো সুস্থ সবলকে দিয়ে ভুল করায়। আবার কখনো নিজ থেকে মেরে ফেলে! কল্পলোকে আছে এরকম অনেক গল্প।  সব গল্পের রেশ বছরের পর বছর থাকে না। আবার অনেক গল্প যুগ যুগ ধরে চলে। কোনটা সত্য, কোনটা মিথ্যা তা যাচাই করতে চেয়েও অনেকে পারেননি। আবার পেরেছেনও অনেকে।  এমনই এক ‘সুইসাইড পয়েন্ট’ ব্রিস্টলের ক্লিফটন সাসপেনসন ব্রিজ। বলা হয় অতৃপ্ত অশরীরী আত্মারা এখানে ঘোরাফেরা করে।

কারণটা কী? ১৯৭৪ থেকে ১৯৯৩ পর্যন্ত মোট ১২৭ জন এই ব্রিজ থেকে পড়ে আত্মহত্যা করেছিল। এরপর প্রতি বছর গড়ে আটজন এখানে আত্মহত্যা করতো। এখন সেটা নেমে এসেছে চারে। কতো শত বেস্টনি, নিরাপত্তাকর্মী-তবুও আত্মহত্যার এই মিছিল থামানো যায়নি। আত্মহত্যা থেমে নেই নয়নাভিরাম সাসপেনসন ব্রিজে। বিশ্বকাপ কভার করতে এসে আসা হয়েছিল ব্রিস্টলে। খুব কাছে এসেও সাসপেনসন ব্রিজ না দেখাটা হতো বোকামি। গিয়েছিলাম প্রথম দিন। সেখানের টুকরো কিছু গল্প তুলে ধরছি এ লেখায়:

ক্লিফটন সাসপেনসন ব্রিজ:  ব্রিস্টল শহরের ক্লিফটন আর উত্তর সমারসেটের লেই উডস-এর সংযোগ ঘটিয়েছে এই ব্রিজ।  অ্যাভন নদীর উপর স্বদর্পে দাঁড়িয়ে আছে ব্রিজটি। দুই পাশে মাত্র দুটি খুঁটি- বাকিটা ঝুলন্ত। দেখলে বোঝার উপায় নেই যে প্রায় দুইশ বছর আগে ব্রিজটি নির্মাণ হয়েছে। ব্রিজের দৈর্ঘ্য ৪১২ মিটার, নদীর পানি থেকে উচ্চতা ১০১ মিটার বা ৩৩১ ফুট।  ইংল্যান্ডের প্রাচীনতম আধুনিক সেতু এটি।  ব্রিজটি নির্মাণের প্রথম ধারণা দেন উইলিয়াম ভিক নামের এক ব্যবসায়ী।  ডিজাইন করেছিলেন ইসামবার্ড কিংডম ব্রুন। ১৮৩১ সালে শুরু হয় ব্রিজের নির্মাণ কাজ। শেষ হতে লেগেছিল ৩৪ বছর।  নির্মাণের সময় দুজন কর্মী নিহত হয়েছিলেন।
 


অপরূপ সৌন্দর্য বেষ্টনিতে সাসপেনসন ব্রিজ: ঝিরিঝিরি বৃষ্টি, সাথে হিম হাওয়া। ওয়ালটনের স্মার্ট ফোন খুলে টেম্পারেচার দেখতেই চোখ ছানাবড়া! তাপমাত্রা ৮ ডিগ্রি। ফিল লাইক ৫! এমন ঠান্ডা আবহাওয়া শরীরের শিরা-উপশিরাকেও কষ্ট দিচ্ছিল। তবুও সাসপেন্সের অপেক্ষায় ছিলাম।  ব্রিজের আগে বামপাশ দিয়ে একটা রাস্তা গেছে। ওদিকে গাড়ি পার্ক করে আমরা গেলাম  ব্রিজের ওপর।  আহ! কি অপরূপ সৌন্দর্য।  সৃষ্টিকর্তা তার সবকুটু যেন ঢেলে দিয়েছেন ব্রিজের দুই পাশে।  একপাশে পাহাড় আরেক পাশে জঙ্গল। নিচে বয়ে গেছে অ্যাভন নদী। নদীর পাশেই ব্রিস্টলের হাইওয়ে। বামপাশে সবুজের আচ্ছাদন। মনে হবে যেন ব্রিস্টল শহর ঢেকে আছে সবুজ কার্পেটে। ওখানে গেলে দেখা যায় গোটা শহর। আমরা গিয়েছিলাম সন্ধ্যার ঠিক আগে। তাই কৃত্রিম আলোর শহরও উপভোগ করতে পেরেছিলাম। ওপরে নীল আকাশ, নিচে ধরণীতে এমন বিস্ময়কর ব্রিজ! কে বলবে এই ব্রিজ নির্মিত হয় ১৮৮৬ সালে।  এর কাঠামো, স্থাপত্য শৈলী ও আশপাশের পরিবেশ দেখে পৃথিবীর যে কেউ বলতে বাধ্য হবে- ‘ওয়াও!’

সুইসাইড পয়েন্ট: ব্রিজের যে পাশে পাহাড়ের অবস্থান ঠিক ওই পাশটাই সুইসাইডাল পয়েন্ট। সর্বপ্রথম কে, কোন জায়গা থেকে সুইসাইড করেছিলেন তা কেউ বলতে পারেন না।  আশপাশে জানা শোনা লোকের অভাব। ইন্টারনেটও দিতে পারেনি সেই তথ্য। সময়ের সাথে সাথে ব্রিজের মাঝপথ থেকেও অনেকে নিজেদের জীবন আত্মাহুতি দিয়েছেন। যে ব্রিজের ওপর দাঁড়ালে তৃপ্তি পাওয়া যায়, মন ভালো হয়ে যায় সেখান থেকে কীভাবে মানুষ জীবনের কঠিনতম সিদ্ধান্ত নেয় বোঝা দায়! শুরুর দিকে আত্মহত্যার হার ছিল অনেক বেশি। সময়ের সাথে সাথে তা কমে এসেছে। পাশাপাশি এখন উঁচু বেষ্টনি নির্মাণ করায় অনেকে চাইলেও নিজের জীবন বিপন্ন করতে পারেন না।  এছাড়া পুরো ব্রিজে নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকে স্বেচ্ছাসেবক। কারো গতিবিধি সন্দেহজনক হলে সাথে সাথে তাকে সরিয়ে নেওয়া হয় ব্রিজ থেকে।

স্কার্ট যখন প্যারাসুট:  সৃষ্টিকর্তা যাকে বাঁচিয়ে রাখেন তার কি মরণের সাধ্য আছে! ‘আত্মহত্যার’ এ ব্রিজের সঙ্গে এমন একটি ঘটনা জড়িয়ে আছে যা বিস্ময়কর। ১৮৮৫ সালে সারাহ এন হেনলি নামের ২২ বছরের এক তরুণী আত্মহত্যা করতে চেয়েছিলেন। সুইসাইড পয়েন্ট থেকে লাফও দিয়েছিলেন।  হয়তো সেটাই ছিল তার শেষ সূর্যোদয়! পৃথিবীতে শেষ মুহূর্ত! কিন্তু সৃষ্টিকর্তার কৃপায় বেঁচে যান সারাহ। তার পরনের স্কার্ট প্যারাস্যুট হিসেবে কাজ করেছিল। ওপর থেকে সারাহ নিচে পড়েছিলেন কাদার মধ্যে। তাতে কপাল খুলে যায় সারাহর। এরপর ৮০ বছর বেঁচেছিলেন সারাহ।
 


কল সামারিয়া ফ্রি: ‘আপনি আত্মহত্যার জন্য এসেছেন? আমাদের এই লেখাটা পড়েছেন? আমাদের সঙ্গে কথা বলুন।  কল সামারিয়া ফ্রি’- ব্রিজের ওঠা-নামা করার পথে দেয়ালে খোদাই করে এবং ব্যানার লাগিয়ে এমন বার্তা দেওয়া হয়েছে। নিচে তাদের ফোন নম্বরও দেয়া।  মূলত সামারিয়া হচ্ছে এনজিও সংস্থা। যারা আত্মহত্যা করতে সাসপেনশন ব্রিজে আসেন তাদের প্রতি সামারিয়ার এ আবেদন।  ভুল পথে পা বাড়ানোর আগে সামারিয়ার সঙ্গে একান্ত আলাপের প্রস্তাব তাদের। জানা গেছে সামারিয়া দীর্ঘদিন ধরে এই কাজ করে আসছে। অনেক মানুষ তাদের সঙ্গে কথা বলে, নিজেদের নিয়ন্ত্রণ করে আত্মহত্যার সিদ্ধান্ত থেকে সরে এসেছে।

বর্তমান চিত্র: ইংল্যান্ডে এলে পর্যটকদের আগ্রহের কেন্দ্রে থাকে লন্ডন আই কিংবা লন্ডন ব্রিজ। প্রধান শহর থেকে একটু বের হলেই সবথেকে আকাঙ্খিত জায়গা হচ্ছে ব্রিস্টল। বুক উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকা ক্লিফটন সাসপেনশন ব্রিজ ব্রিস্টলের মোস্ট ভিজিটেড প্লেস। ঊনবিংশ শতাব্দীতে নির্মিত হওয়া এই ব্রিজটি এখন ব্রিস্টলের সবচেয়ে বিজি ওয়ে।  প্রতিদিন এর ওপর দিয়ে ১১ থেকে ১২ হাজার গাড়ি যাতায়াত করছে।  পঞ্চাশ পেন্স করে খরচ করতে হয় প্রতিটি গাড়িকে। বছর শেষে যে অর্থ ব্রিজ বাবদ আয় হয় তা খরচ করা হয় ব্রিজের উন্নয়নে।

খেলাধুলার সঙ্গে সম্পৃক্ততা: ২০১২ সালে লন্ডন অলিম্পিকের মশাল দৌড় শুরু হয়েছিল এ ব্রিজ থেকে।  মূলত পর্যটকদের আকৃষ্ট করতে লন্ডন ব্রিজের বদলে ব্রিস্টলের ক্লিফটন সাসপেনসন ব্রিজ থেকে অলিম্পিকের মশাল দৌড় শুরু করেছিল আয়োজকরা। এবার অবশ্য ক্রিকেট বিশ্বকাপকে ঘিরে এমন কিছুই করেনি আয়োজকরা। অবশ্য পুরো ব্রিস্টলে বিশ্বকাপের ব্যানার-ফেস্টুনই দেখা গেছে হাতে গোনা কয়েকশ।




রাইজিংবিডি/টনটন/১৭ জুন ২০১৯/ইয়াসিন/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়